মধুসূদন পদকপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক মাসুদ আলম বাবুলের ‘পাগলিনী’, নারীর প্রতি সহিংসতার এক হৃদয়বিদারক গল্প। যার পরিণতি অশুভশক্তির কাছে শুভসত্তার মর্মান্তিক পরাজয়! ভদ্র সমাজের অন্তর্নিহিত পৈশাচিকতা আজও বহমান প্রজন্মের পর প্রজন্মের অস্থি, মজ্জায়। আর তাই বিরুদ্ধ পরিবেশের যাঁতাকলে পিষ্ট, বর্বরোচিত হামলায় নিষ্পেষিত নারী রাহেলা। পারিবারিক, সামাজিক প্রতিকূল পরিবেশে নির্যাতনের শিকার অসহায় এক নারী! রাহেলাকে কেন্দ্র করে যে কাহিনির বিস্তার তাতে লেখকের গভীর জীবনবোধ এবং সমাজের প্রতি অত্যান্ত সচেতন দৃষ্টিপাত লক্ষ্যণীয়। উপন্যাসের সমাজ অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামীণ জনপদ। এখানে ধর্মব্যবসায়ীর ভ-ামি, কাম লোলুপতা, সমাজপতির রক্তচক্ষু, পারিবারিক হিংস্রতা প্রতি পদে পদে রাহেলাকে ক্ষতবিক্ষত করে। ন্যূনতম মানবতাকে তারা গলা টিপে হত্যা করে। রাহেলা সুস্থ জীবন নিয়ে বাঁচতে চায় কিন্তু পারে না! বেঁচে থাকার প্রবল আকাক্সক্ষা সত্ত্বেও ‘বন্ধ্যা’ অপবাদ মাথায় নিয়ে তাকে বিতাড়িত হতে হয়েছে। তার নিঃশব্দ কান্নার অসহায় আর্তি বুক ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। তবু সে পায়নি এতটুকু সহানুভূতি এতোটুকু সমর্থন! পরিবার ও সমাজের বৈপরীত্যের শেকলে বন্দি রাহেলা বলি হলো নিষ্ঠুর সমাজের নির্মম যূপকাষ্ঠে। মার খেতে খেতে বার বার সে উঠে দাঁড়ায়, রুখে দাঁড়িয়েছে কিন্তু প্রবল বিরুদ্ধ চাপে পরাস্ত হয়ে ফিরে এসেছে। বিরুদ্ধ পরিবার, সামাজিক অপতৎপরতা তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে দেয়। তার দৃষ্টিশক্তিকে অন্ধ করে, তাকে পায়ে দলে পরায় পাগলিনীর বেশ। সামাজিক সেন্টিমেন্টকে চালিত করে রাহেলার বিরুদ্ধে। তার সুস্থতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। আর এই ঘূর্ণাবর্তে পড়ে পরাজিত হলো তার অসহায় মাতৃত্ব, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার শুভ ইচ্ছা, ন্যূনতম অধিকার! বর্ণনার সুনিপুণ কৌশলে, সাহিত্যরসের চমৎকারিত্বে ‘পাগলিনী’ পরিপূর্ণ! মাসুদ আলম বাবুল বরাবরই সমাজ সচেতনতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘পাগলিনী’ গ্রামীণ জনপদের অশিক্ষা আর কুসংস্কারের যথার্থ প্রতিফলন। অশিক্ষা আর কুসংস্কারের পরিণতি কতটা ভয়াবহ ও নির্মম হতে পারে তা ‘পাগলিনী’র প্রতিটি পরতে পরতে প্রামাণ্য দলিল রূপে প্রতিভাত হয়েছে।বলা যায় লেখক অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ নিয়ে রীতিমত গবেষণা করেছেন। তিনি ঋদ্ধ লেখক। তাঁর অন্যান্য লেখার মতই এই কাহিনিতেও সচেতন মনোভঙ্গির স্পষ্ট স্বাক্ষর রেখেছেন। মাঝে মাঝে জীবন সম্পর্কে লেখকের নিজস্ব দর্শন উপন্যাসকে সমৃদ্ধ করেছে। ঝরঝরে লেখনশৈলী, কাহিনি বর্ণনায় গতিময়তা অসাধারণ শিল্প সুষমা এনে দিতে সক্ষম হয়েছে। আমার বিশ্বাস, যারা সাহিত্যগুণসম্পন্ন বই পড়তে ভালোবাসেন নিঃসন্দেহে ‘পাগলিনী’ তাঁদের মন জয় করবে। লেখকের জন্য শুভ কামনা রইলোÑ সর্বকালের নির্যাতিত মানুষের প্রতিভূ হয়ে ‘পাগলিনী’ সাহিত্য পাঠকের মনকে আর্দ্র করবে। কামরুন নাহার মুন্নী কবি ও কথাসাহিত্যিক।