স্বপ্নীল সামছ, একজন জন্মগত কবি সত্তার অধিকারী হলেও তিনি পাঠকের নিকট অপ্রকাশিত ছিলেন বহুদিন। তার জন্ম ১ এপ্রিলে; অর্থাৎ মেষ রাশির জাতক, অগ্নির উপমায় আবৃত হলেও চেতনা ও প্রকাশ বোধে স্পষ্ট, প্রেমে প্রগাঢ় ও প্রসারিত, সিদ্ধান্তে অটল প্রাণবন্ত উচ্ছল, অন্যের কষ্টে অশ্রুঝরা-কোমল, কবির জীবন বিশ্লেষণ তারই উপমা। কবি কুমিল্লা জেলায়, মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন, মাতা একজন গৃহিনী, লজ্জাতুন নেছা মজুমদার, পিতা জনাব আইউব আলী খান, একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি, তিন বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয়। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার পিটিআই ইন্সটিউটের প্রাইমারী শ্রেণীতে, বছর খানেক পরে হবিগঞ্জ সেন্টার পাঠশালায় ভর্তি হন অল্প কিছুদিন পড়া শেষে হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের এন্ট্রি ক্লাস অর্থাৎ তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন, মায়ের অতি ভালোবাসার কারণে সপ্তম শ্রেণীতে এফ সি সি তে ভর্তিতে বাধাগ্রস্ত হয়ে, দশম শ্রেণী পর্যন্ত একই স্কুলে অধ্যয়নের সুযোগ পান, তবে চতুর্থ শ্রেণীতেই স্কুল বয়েজ-কাব দলের নেতৃত্ব পান, তারই ধারাবাহিকতায় সপ্তম শ্রেণীতে স্কুল স্কাউট দলের নেতৃত্ব পান এবং নবম শ্রেণীতে স্কুল ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পান। শৈশব কৈশোর থেকে তিনি কঁচিকাঁচার মেলা, খেলাঘর আসর, জুনিয়র রেডক্রস সোসাইটির সক্রিয় সদস্য ও নেতৃত্বের পাশাপাশি স্কাউট মুভমেন্টে বিশেষ অবদান রাখেন, চৌকস স্কাউট হিসেবে শৈশবে খ্যাতির শিখরে পৌঁছেন। বাবার চাকুরীর কারণে এসএসসি পরীক্ষার পূর্বক্ষণে চাঁদপুর হাসান আলী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ভর্তির প্রথম দিন থেকেই স্কুল স্কাউট দলের নেতৃত্ব পান। এসএসসি উত্তর সময়ে চাঁদপুর কলেজে অধ্যয়ন করেন, তখন ইউ ও টি সি/বিএনসিসি সদস্য হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় সামরিক শিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। জনসেবায় তিনি মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে, সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের সেবায় হাসপাতালে রাত্রিযাপনের মতো স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিজেকে নিয়োগ করেন, তাছাড়াও ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের সময় রাস্তার পাশে অচেনা অবহেলিত, লাশ সংগ্রহ করে কবর খোঁড়া দাফন সম্পন্ন করতেন এবং একই কাজে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতেন, রাস্তার পাশে অনাহারী মানুষদের মধ্যে দুধ বিতরণ, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শরণার্থীদের ও মহামারিতে (কলেরা, বসন্ত) অসুস্থ ক্যাম্পে সেবাদান, মহামারিতে গ্রামে গ্রামে জনপথে মানুষদের প্রতিষেধক (টিকাদানে) প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করতেন। জানা যায় যে তিনি স্কুল বন্ধের সময়, স্কুলের সঙ্গীদের নিয়ে, নিজ হাতে কাজ করে টাকা উপার্জন করার জন্য ‘উপার্জন সপ্তাহ’ পালন করেন, এই অভিনব চর্চায় হবিগঞ্জ শহরে তার স্কুল এবং প্রশাসন কর্তৃক প্রশংসিত হন। জনসেবায় তার পদচারণার পাশাপাশি, শৈশবেই তিনি সংগঠক হিসেবে; হবিগঞ্জে চঞ্চল সংঘ, অগ্নিবীণা সংঘ, চাঁদপুর মুক্তপাড় স্কাউট দল এবং সাইন্টিয়া সেল-বিজ্ঞান ক্লাব, পাঠাগার-সংগঠক হিসেবে যুক্ত হন। তিনি এত ব্যস্ততার মাঝেও কবিতা আবৃত্তি, নির্ধারিত বক্তৃতা, উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, খেলাধুলায়- দাবা, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, বাস্কেট বল ইত্যাদি বিষয়ে চৌকস হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ে পুরস্কারে অভিনন্দিত হন। তিনি শৈশব থেকেই সীমিত আকারে বিভিন্ন সময় অভিনয় শিল্পী হিসেবে তার সুকুমারবৃত্তি চর্চা করেন, হবিগঞ্জ টাউনহলে “চোরাগলি মন” নাটকে জীবনে প্রথম শিশু অভিনয় শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, পরবর্তীতে স্কুল এবং নিজ এলাকায় অভিনয় চর্চা বহাল রাখেন। তার সহ-পাঠ ক্রমিক কার্যাবলি (এক্সট্রা কারিকুলাম একটিভিটিস) নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের বিচরণ গণ্ডি ছেড়ে জেলা, ডিভিশন ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়কে স্পর্শ করে। তিনি দুর্লভ বস্তু সংগ্রহ-প্রতিযোগিতায়ও পুরস্কৃত হন। ১৯৭১ সালে তিনি বিকেজেসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে, গোপন প্রশিক্ষণেও শিশুযোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু মার্চ মাসের কালোরাত্রির পর নিজ পরিবারের সাথে, হবিগঞ্জ শহর ত্যাগ করে আত্মরক্ষার জন্য অন্যত্র চলে যাওয়ায় যোদ্ধা হওয়ার স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়, এই অপূর্ণতা পূর্ণ করার জন্যই হয়তো বা শিল্প সত্তাকে পাশ কাটিয়ে পরবর্তীতে সৈনিক জীবন বেছে নেন। এইচএসসি’র পর পরই ভাটিয়ারি “বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমী”তে দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণে’ যোগদান করেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (বিএসসি) সম্পন্ন করেন। পরে সেনা কর্মকর্তা হিসেবে বর্তমান চুয়েট, (ভূতপূর্ব চট্টগ্রাম বিআইটি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক সম্পন্ন করেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি বিএ এলএলবি সম্পন্ন করেন। মোট তিনটি পৃথক বিষয়ে গ্রাজুয়েশনের পাশাপাশি একটি বিষয়ে এমফিলসহ মোট ৪টি পৃথক বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তৎপরবর্তীতে, “ব্যবসা ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতিতে” পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। লেখক পেন নেইম ‘স্বপ্নীল সামছ’ হিসেবে পরিচিত হলেও কর্মজীবনে তিনি সেনাবাহিনীর একজন ওয়ান স্টার জেনারেল হিসেবে, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান থেকে বদলি হয়ে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থায় উপ-মহাপরিচালক পদে যোগদান করেন এবং তথা হতে স্বাভাবিক নিয়মে অবসরে আসেন। তিনি কর্ম জীবনে ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গনে- বৈচিত্র্যময় ও বর্ণাঢ্য ভিন্নধর্মী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, ফলে তার অভিজ্ঞাতর ভাণ্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ; তিনি একজন একাধারে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসক এবং বিশ্লেষক, তিনি সেনাবাহিনীতে দীর্ঘ চাকুরীর পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গনে চাকুরীর অংশ হিসেবে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রকৌশল উপদেষ্টা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার পরিচালক (অভ্যন্তরীণ শাখা), প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থায় কর্নেল জিএস, এবং উপ-মহাপরিচালক, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, জাতিসংঘে রুয়ান্ডার একটি বাংলাদেশ কন্টিজেন্টের উপ- অধিনায়ক হিসেবে রুয়ান্ডার মেসাকারের একজন চাক্ষুস সাক্ষী, এ্যাঙ্গলায় বোম-ডিস্পোজাল দলের কমান্ডার এবং সুদানে, জাতিসংঘ জয়েন্ট মিশন এনালাইসিস সেন্টারের কর্ণধারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যতিক্রমধর্মী দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে একটি মানবাধিকার সংগঠন তাকে বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ‘মানবাধিকার পদক-২০১৪’ তে ভূষিত করেন। কবি স্বপ্নীল সামছ দশম শ্রেণীতে তার এক পদার্থ বিদ্যার গৃহশিক্ষকের তাগিদে স্বাধীনতার উপর কবিতা লিখে, ‘বয়সসীমা-মুক্ত গ্রুপে’, স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান লাভ করেন। বিভিন্ন ম্যাগাজিন আয়োজকদের চাপে পড়ে কবিতায় হাত দেন, সেই বয়সেই নিজস্ব গণ্ডিতেই ‘স্বপ্নীল’ ছদ্মনাম বা পেন-নেইম ব্যবহার শুরু করেন। কৈশোর-যৌবন সন্ধিঃক্ষণে সেনাবাহিনীর ব্যস্ততায় সৌখিন কবিতা লেখা প্রায় স্থবির হয়ে যায়, তবে ধীরে ধীরে সৈনিক জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার পর বিভিন্ন সময় একান্ত নিজ মনের তাগিদে লেখনি চর্চা চালিয়ে যান। তার সেই সংগ্রহ ভাণ্ডার পাঠকের জন্য উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিলে প্রকাশক হিসেবে অনেকের সাথে বাংলানামা প্রকাশনার, পক্ষে কবির সৃষ্টি দেখা ও পড়ার সুযোগ হয়। আমাদের ধারণা জন্মে যে, তার কবিতা সাবলীল, সর্বকালের এবং তার কবিতা সমাজের অগ্রত্রায় ভ‚মিকা রাখার মতো; তাই আমাদের প্রকাশের এই আয়োজনে আমরা গর্বিত। প্রকাশক হিসেবে গত প্রায় ২০ বছর যাবৎ লেখকের বৃহৎ-পরিবারের সদস্যের সাথে যোগাযোগ থাকায় তার সমন্ধে সম্যক জানা; স্বীকৃতি দিয়ে যার কবিতার যাত্রা শুরু হয়, আমি আশা করি তার কবিতার আঙ্গিণায় প্রথম প্রকাশ হলেও “সত্তার গভীরে নীরবে” পাঠকের হৃদয়ে সমাদৃত হবে এবং তার সংগ্রহশালার থলি থেকে আরো অনবদ্য সৃষ্টি অচিরেই আমাদের কাছে; তথা পাঠকের কাছে খোলসমুক্ত হবে।