বাঙালি জাতি নৃশংসতার কাছে পরাভব মানে না হাজার বছরের বাঙালি কোনদিন কোনরকম নৃশংসতার (হোক সে সাম্প্রদায়িক, জাতিগত বা দলগত, নয়তো অন্যকিছুর) নিকট পরাজয় মানে নাই, মানবে না। এই বিজয়ের মাসে (২০১৩) ২৪ দিনের অবরোধে যখন কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী জামাত একের পর এক তাদের কিছু চিহ্নিত এলাকায় হরতাল, অবরোধের নামে শিশুসহ বৃদ্ধ নরনারীকে বোমা মেরে, পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে রাস্তা-ঘাটে যানবাহনে, রেল-গাড়িতে চলন্ত অবস্থায় হত্যা করছে আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে থেকে তখন সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন একটি বিজাতীয় (বাংলাদেশী) দলের আস্ফালন আমরা অত্যন্ত মর্ম বেদনার সাথে প্রত্যক্ষ করছি। নৃশংসতা থেকে ট্রাকে বহন করা গবাদি পশুও বাদ যাচ্ছে না। কীসের নেশায় ও কোন শক্তির হাতছানিতে এরূপ ধ্বংসযজ্ঞ ও বর্বরতা চালানো হচ্ছে, তা ভাববার যথেষ্ট অবকাশ রয়ে যাচ্ছে। আর সমস্যাটাই এখানে। সমস্যাটা বহুমুখী দিগন্ত বিস্তৃত। আমি গোড়াতেই উল্লেখ করেছি এটা বিজয়ের মাস। অন্য পিছনের বিজয়ের মাস থেকে এই বিজয়ের মাসের ভিন্নতা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা উঠলেই কিছু লোক দেখি মুচকি হাসে, কেউ বিমর্সতা দেখায়, আবার কেউ কেউ বর্তমানকে নিয়েই কথা বলতে বেশি উৎসাহ দেখায়। এর অর্থ হলো অতীত মুখীন হওয়া ছাড়া বর্তমানকে বোঝা যায় না, আর বর্তমানকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারলে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে, পথ-পাথেয় বিষয়ে, দেশের-সমাজের সংকট-সমস্যা বিষয়ে কোন নিশানা স্থির করা যায় না। ঊনবিংশ শতকে মার্ক্সের আবিষ্কার নিয়ে ব্যাপকভাবে লেখা হয়েছে এবং এটা হলো দ্বান্দিক বস্তুবাদ-যা অনবরত বিকাশমান। এটা বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদও বটে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতি দীর্ঘ বৃটিশ ঔপনিবেশিক-পাকিস্তানি আধা উপনিবেশিক জাতিগত নিপীড়ণমূলক শাসনের ফলে যে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল তারই ফলশ্রুতিতে কতক নিজেদের অর্থনৈতিক নিশানা-লক্ষ্যস্থির করেছিল যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে আমাদের ১৯৭২-র সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছিল যৌক্তিক ভাবে। এটা রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি নামে পরিচিত হয়। এই যুদ্ধে কমিউনিষ্ট-বামরা অর্থবহ অবদান রাখলেও জনগণ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকেই নেতা হিসেবে বেছে নেয় এবং তিনি (শেখ মুজিব) আত্মপ্রকাশ করেন এবং জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃত হন। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গোটা পৃথিবী দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ঢাকা-দিল্লি-মস্কো ও পিল্ডি-পিকিং-ওয়াশিংটন অক্ষ রেখায় যুদ্ধটি সুসম্পন্ন হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বেমালুম ভুলে গিয়ে আজ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যা-সংকট নিরসনের নিস্ফল চেষ্টা ১৯৭৫-র নৃশংস হত্যাকান্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান খন্দকার মোশতাকের কাঁধে পা রেখে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সংবিধানকে চার মূলনীতি মুক্ত একটি দলিলে রূপান্তরিত করেন। এই পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সূচিত রাজনৈতিক আবেশে-পরিবেশে লালিত দ্বি-জাতিত্ব আবার বাঙালির ঘাড়ে চেপে বসেছে। এ থেকে মুক্ত হওয়ার এক ভাঙ্গা গড়া রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আমরা এখন ন্যস্ত হয়ে চালু করেছি দ্বি-দলীয় ধারার পশ্চিমা ধারার রাজনৈতিক দল। পশ্চিমা শক্তিগুলো এতে উৎসাহ দিচ্ছে প্রকাশ্যে।