মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার পক্ষ থেকে আল কুরআন আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা:) এর উপর আরবি ভাষায় নাযিল হয়েছে। তাই কুরআনকে হৃদয় দিয়ে বুঝতে চাইলে আরবি ভাষাতেই বুঝতে হবে। অন্য কোনো ভাষায় কুরআনের আসল বক্তব্যকে সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। তবে কুরআনের মর্মবাণী আরবি ছাড়া অন্য ভাষাভাষী মানুষের উপলব্ধি করার জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন ভাষায় কুরআন অনুবাদ করা হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। কুরআন যখন নাযিল হয়েছিল তখনকার পরিবেশ আর মানুষের চিন্তাধারা কিংবা জীবনযাপন পদ্ধতি যে রকম ছিল, পরবর্তীতে তার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন দেশ এবং জাতির যুগের চাহিদাকে সামনে রেখে কুরআনের নানা ধরনের অনুবাদ হয়েছে। কিন্তু মূল বক্তব্য সবসময়ই একই আছে এবং থাকবে। শুধু পরিবর্তন হয়েছে নতুন নতুন গবেষণা কিংবা আবিষ্কারের উদাহরণ আর বাস্তবতা। বিষ্ময়কর ব্যাপার হলো, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও প্রযুক্তির নব আবিষ্কার সবসময়ই কুরআনের বাণীর সাথে মিলে গেছে। পরস্পর সাংঘর্ষিক কোনো বিষয় কুরআনে পাওয়া যায়নি। বর্তমান যুগ মানব সভ্যতার সবচেয়ে উৎকর্ষ সময় বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাছাড়া নতুন নতুন আবিষ্কার আর প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের কল্পনার জগতকেও যেন হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষও এই বৃত্তের বাইরে নয়। ফলে বাংলা ভাষায় কুরআনের মর্মবাণীকে অনুধাবনের জন্য একটি বাস্তব, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সহজ্ব-সরল কুরআনের বাংলা অনুবাদ করার মানসে এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। কেননা এটা বর্তমান সময়ের চাহিদা। পৃথিবীর একমাত্র গ্রন্থ কুরআন, যার সংরক্ষণের গ্যারান্টি দিয়েছেন মহান সৃষ্টিকর্তা, বিধানদাতা, রক্ষাকর্তা এবং রব, আল্লাহ নিজেই। তাই কুরআনকে যদি কেউ বুঝতে চায়, একে অনুধাবন করতে চায় এবং এই গ্রন্থ থেকে জ্ঞান অর্জন করতে চায়; তার উচিৎ আরবি ভাষা শেখা এবং আরবিতেই কুরআন অধ্যয়ন করা। পাশাপাশি এটাও মানতে হবে যে, এই কুরআনের মধ্যেই সব সময়ের, সব ভাষাভাষীর, সব মানুষের, সব সমস্যার সমাধান রয়েছে। সেই সাথে মানুষের ইহকাল ও পরকালের মুক্তি এবং সুখ-শান্তি-সফলতা এই কুরআনের মাঝেই মহান ¯্রষ্টা রেখেছেন। মানুষের সকাল থেকে সন্ধ্যা, দিন থেকে রাত, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের সবক্ষেত্রে সুখ-শান্তি ও সফলতা পেতে হলে কুরআনকে শেখা, বুঝা এবং মানার জন্য চেষ্টা করে যেতেই হবে। সেই সাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, কুরআনকে পূর্ণাঙ্গরূপে বুঝার চেষ্টা আমৃত্যু অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদেরকে আজীবন কুরআনের ছাত্র হিসেবেই অধ্যয়ন ও গবেষণা করে যেতে হবে। তাই জীবনের সর্বাঙ্গীন উন্নতি আর পরকালের মুক্তির জন্য কুরআন শেখা, বুঝা এবং মানার কাজ অব্যাহত রাখা অবশ্য কর্তব্য। এ অনুবাদে কোনো ধরনের সাংঘর্ষিক বক্তব্য, বাক্য বা শব্দ উদ্ধৃত হলে, ধরে নিতে হবে, এটা অনুবাদের অক্ষমতা বা দুর্বলতা। মনে রাখতে হবে, মহান ¯্রষ্টার বাণী নির্ভুল আর আমাদের ধারণা বা জ্ঞান সীমিত। আল কুরআনে শত শত (৩৩২টি) আয়াতে আল্লাহ, তার রাসূল মুহাম্মদ (সা:) কে ‘বলতে’ বলেছেন। আয়াতগুলো ‘কুল’ দিয়ে শুরু হয়েছে। আবার আল্লাহ, কুরআনে অনেকগুলো কাজ করতে ‘নিষেধ’ করেছেন। কুরআনে শত শত আয়াতে সৎ এবং অসৎকাজের বিশাল বিবরণ এসেছে। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি, আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা:) এর কথা, কাজ, আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, আল কুরআনেই বর্ণিত হয়েছে। তাই আল কুরআন হচ্ছে শরীয়তের মূলনীতি এবং মুসলিমদের জন্য দ্বীনের সংবিধান বা পড়হংঃরঃঁঃরড়হ. কুরআন সকল যুগ, সময়, জাতি এবং সমগ্র বিশ্বের সব মানুষের জন্য পরিপূর্ণ সংবিধান। যে কোন দেশের সংবিধান ছোটই হয়। আবার ঐ দেশে লক্ষ লক্ষ আইন থাকতে পারে। অথচ দেশের কোন আইনই সংবিধানের পরিপন্থী হতে পারে না। কুরআন মৌলিক গ্রন্থ। এজন্যেই কুরআন যাকে হারাম বলেনি বা হালাল বলেছে; তাকে উল্টো করার ক্ষমতা কারো নেই। আবার কুরআন যাকে অত্যাবশ্যক বলেনি বা বাধ্য করেনি; কোন হাদিস, তাফসির, ব্যাখ্যা, ফিকাহ, তাকে বাধ্য বা আবশ্যক করতে পারে না। যদি কেউ করে, তিনি যত বড় আলেম বা আইনবিদ হন না কেন; সেটা আল্লাহর বা শরীয়ত বিরোধী। কুরআনে আল্লাহর ঘোষণা হলো, হে নবি বলো! তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তাতে তুমি কোন কিছুকে হালাল বা কোন কিছুকে হারাম বলার সুযোগ কি আছে? বলো সে ব্যাপারে আল্লাহ কি তোমাকে কোন অনুমতি দিয়েছেন? না তুমি আল্লাহর নামে কোন কিছু বানিয়েছো? (সুরা ইউনুস, ৫৯) তিনি তোমার উপর কুরআন নাযিল করেছেন, সেখানে সবকিছু সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে (সুরা আনআম, ১১৪)। পৃথিবীতে শাইখুল হাদিস হওয়া কঠিন। তবে শাইখুল কুরআন হওয়া তেমন কঠিন নয়। যেহেতু কুরআন মুখস্ত করা সহজ্ব। পৃথিবীতে কুরআনের লক্ষ লক্ষ বিশুদ্ধ হাফিজ আছে। অথচ ঐতিহাসিকভাবেই লক্ষাধিক জাল, জয়িফ হাদিস আছে। বর্তমানে সহিহ, হাসান, জাল, জয়িফ ইত্যাদি প্রায় ৩৫ লক্ষ হাদিসের একজন হাফিজও পাওয়া যাবে না। এরপরও আমরা শাইখুল হাদিস খুঁজছি? আল্লাহ বলেছেন, কুরআনকে তিনি সহজ্ব ও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ বলেন, তিনিই তোমাদের প্রতি বিস্তারিত গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন (সুরা আনআম ১১৪) আল্লাহ আরও বলেন, এটি এমন এক কিতাব, যার আয়াতসমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ হতে (সুরা হুদ, ১)। পৃথিবীর যত হাদিস, ফিকাহ, কিতাব, ফাযায়েল, মাসায়েল, ফাতওয়া, আমল, ব্যাখ্যা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মদিনা-মক্কা-আযহার বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষণা, দেওবন্দ, বুজর্গ, আলেম, ওলামা, পীর, মাশায়েখ কিংবা সুফিদের উদ্ভাবন বা জ্ঞানগর্ভ বিবরণ ইত্যাদি এক পাল্লায় তুললে, কুরআনের একটি আয়াতের (যেমন সুরা ফাতিহার প্রথম আয়াত) সমান হবে না। কিয়ামত পর্যন্ত আগত পৃথিবীর সকল মানুষ সুরা ফাতিহার এ একটি আয়াতের তাত্তি¡ক, বাহ্যিক, অন্তর্নিহিত বিশ্লেষণ, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ ব্যাখ্যা তথা পরিপূর্ণ অর্থ বোঝার যোগ্যতা রাখে না। মানুষ এতটাই দুর্বল। একজন নবজাতক শিশুর কাছে মহাবিশ^ যতটা জটিল ও বিশাল; মানুষের কাছেও আল্লাহর বাণীর অর্থ পরিপূর্ণ বুঝা ততটাই কঠিন এবং অসীম। তাই প্রতিটি মানুষ আল্লাহ যতটুকু যোগ্যতা দিয়েছেন কুরআনের ততটুকুই হৃদয়ঙ্গম করবে তথা বুঝবে এবং সে অনুযায়ী আমল করবে। আল্লাহর কিতাবের তাফসির করার সামর্থ্য আল্লাহ ছাড়া কারও নেই (সুরা ইমরান ১৩৮)। বর্তমানে ইসলামী স্কলাররা বা আলেম ওলামারা; কুরআনের বিশুদ্ধ তেলাওয়াত ও মুখস্থকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন (অবশ্যই ব্যতিক্রম রয়েছে)। আবার ধর্মের সাথে নিজস্ব স্বার্থকে মিলিয়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক নানা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন একদল তথাকথিত জ্ঞানী মুসলিম সম্প্রদায়। ফলে আজ এসব ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যার কারণে সাধারণ মুসলিমরা খাবি খাচ্ছে এবং তাদের করণীয় নিয়ে সঠিক দিক নির্দেশনা পাচ্ছে না। আবার একদল পীর, বুযুর্গ, আলেম, কামেল, নেতা, তথাকথিত জ্ঞানী সম্প্রদায় ধর্মের নামে পছন্দসই তাফসির, কুরআন অননুমোদিত হাদিস এবং নানারকম মুখরোচক কাহিনী যোগ করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বিভিন্ন দল, উপদল, গ্রæপ, ফেরকা, তৈরী করে নানারকম ধর্মীয় চর্চা প্রবর্তন করেছে এবং এখনো করছে। এজন্যেই আজ ইসলামে এতো দল, গোষ্ঠী, গ্রæপ, উপদল, ফেরকা, ভিন্ন মতাদর্শী ইত্যাদি। কোথাও কোনো ঐক্য নেই। যেখানে আল্লাহ মুসলিমদের ঐক্যের নির্দেশ দিয়েছেন। যেকোনো মূল্যে মুসলিম ঐক্য বজায় রাখা অত্যাবশ্যক। আল্লাহ কুরআনে বলেন, আর তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হাতে ধারণ করো; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না (সুরা ইমরান, ১০৩)। মুসলিমদের মাঝে কোনোরূপ দল, উপদল, গ্রæপ, ফেরকা বা বিভাজন সৃষ্টি বা সৃষ্টির চেষ্টা করা; তা যেই করুক না কেন; সেটা ইসলাম ও কুরআনের বিপরীত কাজ এবং আল্লাহর হুকুমের পরিপন্থী। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলামের তথা কুরআনের ভুল ব্যাখ্যায় ও ভুল চর্চায় একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে; তা থেকে বেরিয়ে আসা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই আজ আমরা হালাল খাদ্যের অন্বেষায় ব্যতিব্যস্ত থাকি; অথচ উপার্জন হালালের গুরুত্ব যে প্রধান বিষয়; তা ভুলতে বসেছি। মিথ্যা, পণ্যে ভেজাল, অপরকে ঠকানো, অপরের হক নষ্ট করা, নিজের স্বার্থ উদ্ধারে যে কোন পথ অবলম্বন করা, অন্যের ক্ষতি করা, গালমন্দ ও রাগারাগি করা, লোভ-হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, গীবত-অপবাদ-চোগলখুরী, ঘুষ খাওয়া, রাষ্ট্রীয় সম্পদ তসরুপ করা, রাষ্ট্রীয় অর্থ পাচার করা, অপরের সম্পদ জোর দখল করা, অধৈর্য্য হওয়া, আমানতদারী নষ্ট করা; এসব হারাম এবং ভয়াবহ পাপ। আল কুরআন এসব ব্যাপারে সরাসরি ও স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। এসব শতভাগ ফরয কাজ। অথচ আজ কোন খাদ্য বা প্রাণী হালাল বা মাকরুহ? সেসব আমাদের কাছে অতি জরুরী। অথচ কুরআন এ ব্যাপারে স্পষ্ট, সহজ্ব, সরল, ও বাস্তব না দিয়েছে (সুরা বাকারা, ১৬৮-১৭৬, সুরা মায়েদা, ১-৫, এবং সুরা মায়েদা, ৮৭-৯৬)। ইসলাম ধর্ম কারও পৈত্রিক সম্পত্তি নয়। ধর্ম বা দ্বীনের নামে কুরআন বহির্ভুত এবং মনমতো বিচার, বিধান, সমাধান, ফতওয়া এবং ব্যাখ্যা দিয়ে দলাদলি হানাহানি করা নিষিদ্ধ। অমুকে বেদাতি, তার আকিদা সহিহ নয়, ও কাফের, সে মুরতাদ, অমুকের ঈমান চলে গেছে; এ ধরনের ফতওয়া ও মত একজন আলেম, ওলামা, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, বুজর্গ এবং অন্য কোনো ইসলামী স্কলার দিতে পারে না। বর্তমানে এ ধরনের ফতওয়া বা ব্যাখ্যা দিয়েই অন্যদের নিজ মতের ভিন্নাবলম্বীদের ধরাশায়ী করা হচ্ছে। কী করে ইসলামে এসব হয়? এজন্যেই আজ সাধারণ মুসলিমরা ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হচ্ছে তথা ধর্ম ত্যাগ করছে এবং এ ধরনের কাজেই তথাকথিত ইসলামী স্কলাররা হাদিস, ফিকাহ, তাফসির, ইত্যাদিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার করে না (ফতওয়া দেয় না) তারাই কাফির, জালিম বা সীমালঙ্ঘনকারী, ফাসিক (সুরা মায়েদা ৪৪-৪৫, ৪৭)। পৃথিবীর সকল আলেম ওলামা একমত যে, মহানবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস বা সুন্নাহ না মানা বিদআত। আর সকল বিদআতই জাহান্নামি। তাহলে যারা কুরআনের বিপরীত ফতওয়া, বিধান ও বিচার কাজ করে তারা কী? অবশ্যই বড় বিদআতি! তবে যে কোন তাফসীর, হাদিস, ফিকাহ, অন্যান্য ইসলামী মনিষীদের গ্রন্থ বা কিতাবের যে সকল বক্তব্য, মত ও দিক নির্দেশনা কুরআনের সাথে মিলে, সমর্থন করে এবং সহায়ক; তা ক্ষেত্রবিশেষ গ্রহণ করা যেতে পারে। আমরা নারিকেলের নরম অংশ খাই, তথা পানি পান করি। অথচ নারিকেলের ছোবরা দিয়ে পাপোশ বানাই। কেউ নারিকেল গাছ বা ছোবরা খায় না। একই সাথে কুরআনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ তথা কুরআনের বিপরীত, অতিরিক্ত, অতিরঞ্জিত, ইত্যাদি কোন ধরনের তত্ত¡, তথ্য, ব্যাখ্যা, বিবরণ, বিধান, ফতওয়া ও সমাধান সেটা কুরআন বাদে যে কোনো উৎস থেকেই নেওয়া হোক না কেন, তা গ্রহণ করা; নারিকেলের প্রয়োজনীয় অংশ রেখে অপ্রয়োজনীয় অংশ খাওয়ার মতোই। বর্তমানে তথাকথিত কিছু নব্য জ্ঞানী বা পÐিত এবং আধুনিক কিছু ব্যক্তি তাদের নিজস্ব মতকে প্রতিষ্ঠা করতে কুরআন ব্যতীত সকল বিষয়কে ঢালাওভাবে পরিত্যাগ করতে বলেন এবং করে থাকেন। এটা একটা চরমপন্থী সিদ্ধান্ত এবং এক ধরনের হঠকারিতা। যাদের মাধ্যমে আমরা দ্বীনকে এতদুর এবং এভাবে পেলাম; তাদেরকে পুরোপুরি অস্বীকার করে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ মোটেও সঠিক নয়। যেসব হক ও বিশুদ্ধ আলেম ওলামা, ইসলামী স্কলাররা; ইসলামী জীবন যাপন করছেন; অনেক ত্যাগ স্বীকার করে ধর্ম প্রচার ও দ্বীনকে প্রসার করছেন; তাদের বাদ দিয়ে কুরআনের অনুবাদ পড়ে, হুট করে নিজের খেয়াল খুশিমত জীবন চালাতে শুরু করাটাও আরেক ধরনের হঠকারিতা। এটাও শয়তানের একটা চক্রান্ত; তাগুতের অনুসরণ; নিজের খেয়াল খুশিরই অনুকরণ। যুগে যুগে আগত ইসলামী বিশুদ্ধ স্কলাররা ও হকপন্থী আলেম ওলামাদের ত্যাগ ও কর্মকে অস্বীকার করা এক চরমপন্থী সিদ্ধান্ত। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট; যেসব ইসলামপন্থী নেতা, আলেম, ওলামা, পীর, বুজুর্গ, তথাকথিত ইসলামী স্কলাররা ধর্মের নামে মানুষকে কাফির, মুরতাদ, ধর্মদ্রোহী, ধর্মত্যাগী এবং মহাপাপী ফতওয়া দিয়ে তাদের ফাঁসি, হত্যা, দেশত্যাগ, সমাজত্যাগ করার দাবি করে এবং জনতার মাঠ গরম করে; তাদের সাথে একত্বতা প্রকাশ বা সমর্থন করা; আল কুরআন অনুমোদন দেয় না (সুরা কাহাফ ২৯, আবাসা ১১-১৬)। ইসলামের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও ফায়সালা কুরআনের আলোকেই হতে হবে। কুরআনের বিশুদ্ধতা এবং গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে সকল মুসলিমকে এক হতেই হবে। কুরআনে শব্দের চয়ন, ছন্দের বুনন, বাছাই, ব্যঞ্জনা, সুর, লয়, অর্থ, সবই বিষ্ময়কর, মনোমুগ্ধকর, হৃদয়গ্রাহী, অন্তর ও মর্মস্পর্শী; যা পাঠককে অভিভূত, আপ্লুত, উদ্বেলিত, বিচলিত করে এবং তৃপ্তি ও শান্তি দেয়। কুরআন নাযিলের সময় আরবের বড় বড় কবিরা তাদের কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে ইসলামে এসে কুরআনের সুরা তেলাওয়াত করে অভিভূত হয়েছে এবং আত্মতৃপ্তি পেয়েছে। অথচ তখন ছিল কবিতা বা ছন্দের চরম উৎকর্ষের যুগ। কুরআনই সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ, বিস্তারিত, অনুসরণীয় এবং একমাত্র ধর্মীয় বিধান বা শরীয়তের মাপকাঠি। এর পাশাপাশি অন্য কোন কিছুকে দাঁড় করানো ইসলাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনার পরিপন্থী। আল্লাহর হিদায়াত তথা ইহ ও পরকালের সফলতা এবং সঠিক ইসলাম খুঁজতে, মানতে, অনুসরণ করতে; একমাত্র কুরআনকেই কষ্টিপাথর এবং বিবেচ্য ধরতে হবে। কুরআন, কুরআনকেই হুদাল্লিল মুত্তাক্বিন বলেছে এবং হেদায়াতের একমাত্র উপকরণ ও বিবেচ্য বলেছে। মহানবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশুদ্ধ কথা, বাণী, কাজ ও সম্মতির বিবরণ তথা শতভাগ বিশুদ্ধ সুন্নাত একমাত্র কুরআনেই রয়েছে। ইসলামের বিশুদ্ধ তথ্য ও সত্য পেতে, কুরআনই একমাত্র নির্ভূল ও পরিপূর্ণ গ্রন্থ বা ৎবভবৎধহপব। আল কুরআনেই ইসলামের বিশুদ্ধ, নির্ভুল ও পরিপূর্ণ শরীয়ত তথা করণীয়, বর্জনীয়, আদেশ, নিষেধ এবং উপদেশ বর্ণিত হয়েছে। আল কুরআনের সকল বর্ণনা, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সহজ্ব, সরল, বিশদ, সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ, সত্য, বিশুদ্ধ এবং সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। কুরআন পাঠকের জন্য প্রয়োজনীয়, উপযুক্ত এবং উপকারী জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সমাধান তুলে ধরে। আল কুরআনের ব্যাখ্যা সহজ্ব এবং প্রদর্শিত পথ সরল। কুরআন পাঠককে এর লেখক এবং রবের সাথে সম্পর্ক করিয়ে দেয়। এ সম্পর্ক সৃষ্টি এবং দৃঢ়করণের জন্য, পাঠককে বারবার কুরআনকে পড়তে, বুঝতে, অনুধাবন করতে হয় এবং নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে হয়। আল কুরআন এমন একটি সত্য, বিশুদ্ধ ও চ‚ড়ান্ত ঐশী গ্রন্থ; যে এর পাঠক ও উপদেশ বাস্তবায়নকারীকে জান্নাতে পৌঁছে দেয়। অপরদিকে আল কুরআনের সন্দেহকারী, অবিশ^াসী এবং সত্য গোপনকারীকে জাহান্নামে পৌঁছে দেয়। এখানে পাঠক স্বাধীন এবং তার পছন্দ সম্পূর্ণ নিজস্ব। আসলে আল্লাহ যাকে চান তাকে হেদায়েত দান করেন। মহান আল্লাহ আমাদের সত্য বুঝ ও হেদায়েত দান করুন। আমিন। ইতোপূর্বে এ গ্রন্থটি ‘বাস্তব এবং বিজ্ঞানভিত্তিক আল কুরআনের সরল বাংলা অনুবাদ’ শিরোনামে বড় ও পকেট আকারে কয়েকটি সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। এতে পাঠক-পাঠিকা, শুভানুধ্যায়ীদের ব্যাপক সাড়া পাওয়া গিয়েছে। এর উপর ভিত্তি করেই ‘আল কুরআন সরল বাংলা অনুবাদ’ শিরোনামে ব্যাপক বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা তথা বিষয় ও শাব্দিক অভিধানসহ বর্ধিত কলেবরে নতুনভাবে প্রকাশিত হলো। আল কুরআনের এই বাংলা অনুবাদ গ্রন্থটিকে সহজ্ব, সরল, প্রাঞ্জল, বাস্তব, বিজ্ঞানভিত্তিক, সর্বোপরি সব শ্রেণির পাঠক-পাঠিকার কাছে সাদরে গ্রহণযোগ্য করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে। এটিকে অনুবাদ গ্রন্থ না বলে কুরআনের মর্মবাণী বা সরল উপস্থাপনা বলা যেতে পারে। এখানে ভাষাগত, তথ্যগত বা অন্যকোন অনিচ্ছাকৃত ভুল দৃষ্টিগোচর হলে প্রকাশককে জানালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সংশোধন করা হবে। এছাড়া যে কোনো ধরনের উপদেশ সাদরে গৃহীত হবে। এ প্রকাশনার সাথে সম্পৃক্ত সবাইকে এবং যারা এ গ্রন্থ পড়ে সামান্য উপকৃত হবেন তাদের সবাইকে আল্লাহ ক্ষমা করে দিন, কবুল করে নিন; তথা ঈমান ও হেদায়েতের মতো শ্রেষ্ঠ সম্পদ দান করুন, আমিন। ড. ঈসা মুহাম্মদ