বলরাম শর্মা (১৯১১-১৯৮৯) কবি ও সাধক ছিলেন। ঝিনাইদহের কথা মনে এলেই মনে পড়ে পাঞ্জু শাহ কিংবা পাগলা কানাইয়ের নাম। কোনো কোনো গবেষক লালন সাঁইকেও ঝিনাইদহের জাতক প্রচার করলেও তিনি শেষতক কুষ্টিয়ারই সন্তান। ঝিনাইদহের হলে তিনি যশোরের অংশ হতেন। কিন্তু লালন তো নদিয়াভূমির তথা কুষ্টিয়ার। সে বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই। ঝিনাইদহ তো কুষ্টিয়ারই সন্নিহিত অঞ্চল। তাই ঝিনাইদহবাসী লালনকে নিয়েও গর্ব করে যেমন ফরিদপুর কিংবা সিলেটের মানুষও লালনকে নিজের করে ভাবে। লালন এখন কালিক ও আঞ্চলিক সীমার ঊর্ধ্বে। ঝিনাইদহ অঞ্চল মরমিকবিদের জন্য ঊর্বর ক্ষেত্রে। পাগলা কানাই (১৮০৯-১৮৮৯), পাঞ্জু শাহ (১৮৫১-১৯১৪), অমূল্য শাহ (১৮৭৯-১৯৫২) শুকচাঁদ শাহ (১৮৮৭-১৯৫০) প্রমুখ মরমিকবির পাশাপাশি অজ¯ নাম প্রকটিত। এঁদের মধ্যে বলরাম শর্মার নাম আমরা উচ্চারণ করতে পারি পরম শ্রদ্ধায়। বলরাম শর্মা আশ্রমবাসী কিংবা আখড়াবাসী সাধু ছিলেন না। ছিলেন গৃহবাসী সাধক। সামাজিক ও সংসারিক মানুষ হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। করাচি থেকে এইচএমবি পাস ডাক্তার কিংবা ঝিনাইদহ কোর্টের প্রোসেস সার্ভেয়ার হলেও ছিলেন শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সেবক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভূমিকা রেখেছেন, সাহিত্য সংগঠন করে নিয়মিত সাহিত্যসভার আয়োজন করেছেন, সাহিত্য-সংকলন প্রকাশ করে স্থানীয় সাহিত্যিকদের আত্মবিকাশের সুযোগ করে দিয়েছেন। আর ভেতরে-ভেতরে প্রসারিত হয়েছে তাঁর মরমিকবিসত্তা। আধুনিক সমাজজীবনে বাস করেও তাঁর লোকচেতনা অম্লান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শলালিত অসাম্প্রদায়িকতার বাণীও তিনি প্রকাশ করেছেন হিন্দু মুসলিম প্রভেদ কোথায় এ ভব সংসারে, কেউ পূজা কেউ রোজা করে আকারে আর নিরাকারে। মরমিকবিরা এইসব ভেদবুদ্ধির ওপরেই অবস্থান করেছেন। জাগতিক সত্তার ভেতরেও দেহতত্ত্ব ও অধ্যাত্ম উপলব্ধি প্রকাশ করেন। বলরাম শর্মাও তাঁর ব্যতিক্রম নন। তাঁর একটি দেহতত্ত্বের গানে দেখি চাষের উপমা মনকে চাষী বানাও এবার ফসল যদি চাও ফলাতে হাল চালাও মন জমির ওপর দশে ছয়ে ষোল চাষে, ফেলরে মন জমি চষে ও যে মুলো বুনো যতন করে, দিবে জমিতে জৈব সার। এই গানের উপমাসম্পদ বিবেচনা করলে সাধক রামপ্রসাদের সঙ্গেই তুলনীয় মনে হতে পারে। আধ্যাত্মিক গানেও বলরাম শর্মার পারদর্শিতা লক্ষণীয়। গুরুতত্ত্বের একটি বাণী উদ্ধার করে তাঁর মানসিক বিনয় ও আত্মনিবেদনের স্থিতাবস্থা অনুভব করা যেতে পারে গুরু, দেখা কি পাবো তোমারে, এই সাধুর বাজারে। তুমি যাঁরে করো দয়া সে যেন পায় দেখা তোমারে আমি অতি মূঢ়মতি না জানি ভক্তি-স্তুতি, তুমি মোরে করো গতি, সুমতি দাও আমারে। বলরাম শর্মা কেবল মরমিকবি ও সাধকই নন, আধুনিক কবিতারও চর্চা করেছেন। কিন্তু আমরা তাঁর মরমিবাদের ফসলটুকুই ঘরে তুলে ধন্য হতে চেয়েছি। তাঁর অজ¯্র রচনা থেকে নির্বাচিত কয়েকটি গীতিকবিতার সংকলন প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছেন তাঁরই সন্তান, অধ্যাপক কবি সুনীতা শর্মা এবং সত্যাদর্শের আদর্শের অনুসারী ও প্রতিশ্রুতশীল সাহিত্যকর্মী মো. ইমরান হোসেন। তাঁরা কেবল বলরাম শর্মার রচনার সংকলনই প্রকাশ করেননি, তাঁর জীবনতথ্য সংকলন এবং সমকালীন মূল্যায়নও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এই গ্রন্থ ঝিনাইদহের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তো বটেই, বাংলাদেশের লোকসাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেই একটি নবতর উদ্যোগ হিসেবে গ্রহণীয় হবে। আমি দুই সম্পাদককেই শুভেচ্ছা জানাই। এই গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করি। ড. তপন বাগচী কবি গীতিকার ফোকলোরবিদ উপপরিচালক (গবেষণা) বাংলা একাডেমি, ঢাকা
Title
ঝিনাইদহের মরমী কবি বলরাম শর্মা ও তাঁর কালজয়ী সাধন সংগীত