কাহিনি-সংক্ষেপ ‘নৃশংসতার তৃতীয় পুরাণ’ রাজনৈতিক ও সামজিক উপন্যাস। এ উপন্যাসের অন্তর্গত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মানব-সমাজ গঠন সংলগ্নকাল থেকে চলমান কাল পর্যন্ত। তবে আপাত দৃষ্টিতে বলতে হবে এ-উপন্যাসটি মণ্ডলটোলা নামক একটি গ্রামে বসবাসরত দুটি গোষ্ঠীর বিগত দুই শতাব্দির বিরোধ ও নৃশংসতার আখ্যান। যে সময় দিল্লির সম্রাট ও স্থানীয় রাজা-নবাবদের তোষামদি করে ইংরেজরা বাংলায় বাণিজ্য-বিস্তারের চেষ্টা করছে। তারা বাংলার বিভিন্ন স্থানে আড়ং প্রতিষ্ঠা করে তাদের স্বদেশ থেকে বয়ে আনা পলেস্টার কাপড়সহ নানা সামগ্রী বিক্রয় শুরু করেছে। আবার তাদের দেশের শিল্পের কাচামাল হিসেবে কোথাও কোথাও বাঙালির ফলানো ফসল মশুরি কেনা শুরু করেছে। সে সময় নওদাচর নামক গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব আলী মণ্ডলের ছোটো ভাই কাদের মণ্ডল আড়ং-এ মণ দুই মশুরি বিক্রয় করেন। কিন্তু আড়ং-এর লোকেরা গ্রামের অনেকের মতো তাকেও সময়মতো দাম দেয় না। ফলে আড়ং নিয়ে আলী মণ্লেডর মনে অসন্তোষ তৈরি হয়। সে সময় গ্রামের লোকেরা আলী মণ্ডলের কাছে আসে। আড়ং থেকে তাদের পাওয়া আদায় করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। ফলে আলী মণ্ডল এক সকালে আড়ং-এ যান। তখন সাদা চামড়ার রগচটা এক ইংরেজ আলী মণ্ডলের সাথে অসৌজন্য আরচরণ করে এবং তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে আলী মণ্ডলকে সে তার ঘোড়ার খোয়াড়ে আটকে রাখে। ফলে আলী মণ্ডল রাজার কাছে অভিযোগ করার সিদ্ধান্ত নেন। সে সংবাদ আড়ং-এ পৌঁছে যায়। ফলে সাদা চামড়ার রগচটা সেই লোকটা এক দুপুরে ঘোড়া ছুটিয়ে আলী মণ্ডলের বাড়ির সামনে দাঁড়ায় এবং চিৎকার করে আলী মণ্ডলকে ডাকতে থাকে। আলী মণ্ডল বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালে আড়ং-এর বিপক্ষে চক্রান্ত করার অভিযোগ এনে লোকটি তাকে চাবুকাঘাত করতে থাকে। এ দৃশ্য দেখে আলী মণ্ডলের ছোটো ভাই কাদের মণ্ডলের মাথা গরম হয়ে যায়। সে বাড়ির ভেতর থেকে ধারালো বল্লম এনে লোকটির বুক বরাবর ছুঁড়ে মারে। সেটা গিয়ে বিদ্ধ করে সাদা চামড়ার রগচটা লোকটার বুক। সে ঘোড়া থেকে পড়ে যায় এবং টিকটিকির কাটাপড়া লেজের মতো তড়পাতে তড়পাতে নিঃসাড় হয়ে যায়। তখন আলী মণ্ডল তার চার ভাইকে নিয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে যান। ইংরেজদের আক্রোশ থেকে বাঁচার জন্য পরবর্তীকালে আলী মণ্ডল ভাইদের নিয়ে নিজের গ্রাম থেকে অনেক দূরে এক জঙ্গলের মাঝে নতুন আবাস গড়ে তুলেন। সেখানে পরিবারের সকলকে এনে বসবাস করতে থাকেন। পরবর্তীকালে তাদের যোগাযোগ ঘটে রানী ভবানীর হাটের সাথে। সে হাট তাদের জীবনের বাঁক বদলে দেয়। কারণ সে হাটে সকল প্রকার শস্য বেচা-কেনা হয় দেখে তারা ফসল ফলানোতে মন দেয়। একসময় গায়ের ঘামে ফলানো ফসল বিক্রি করে তারা বেশ টাকার মালিক হন। তারা সভ্যসমাজের মানুষও হয়ে ওঠেন। একসময় আলী মণ্ডল পাকা বাড়ি করার পরিকল্পনা করেন। ফলে সেখানে এক বৃদ্ধ সরদারের সাথে ইট তৈরি, শুকানো ও পোড়ানোর কাজে আসে একদল কারিগর। বৃদ্ধ সরদার লোকটির প্রতি আলী মণ্ডলের মন মমতাপূর্ণ হয়ে ওঠে। আলী মণ্ডল তাকে পরিবার নিয়ে সেখানে বসত গড়ার প্রস্তাব দেন। সম্ভবত সরদার লোকটিও তখন একটি নির্ঝঞ্ঝাট জীবন চাচ্ছিল। সে তার পরিবারের লোকদের নিয়ে আলী মণ্ডলের নতুন জনপদে থেকে যায়। আলী মণ্ডলের পৃষ্ঠপোষকতায় বৃদ্ধের ছেলেরা আদিকালের কৃষিকাজে মন দেয়। তবে আলী মণ্ডলের মৃত্যুর অনেক পরে এসে সেখানে মণ্ডল ও সরদারদের মাঝে গোষ্ঠীগত বিরোধ সৃষ্টি হয়। একসময় তাদের বিরোধের সাথে নৃশংসতা জড়িয়ে যায়। বিশ শতকের শেষদিকে এসে তাদের সে বিরোধ ও নৃশংসতা রাজনৈতিক ভিত পায়। ‘নৃশংসতার তৃতীয় পুরাণ’ মূলত রাজনৈতিক ও সামাজিক উপন্যাস। এ উপন্যাসে বিগত দুই বছর উঠে এসেছে।