প্রসঙ্গ কথা কুসুম খেমানীর উপন্যাস লাবণ্যদেবীর গল্পের বিস্তৃতি এতটাই যে, এতে একটি পরিবারের পাঁচ প্রজন্মের গাথা প্রথিত হয়েছে। গাথা এজন্যই বলা হচ্ছে যে, এর মধ্যে শুধু প্রভাবতী, জ্যোতির্ময়ীদেবী, লাবণ্যদেবী ও তাঁদের সন্তান-সন্ততি আর নাতিপুতিদের কথাই নেই; বরং সেসবের অন্তরালে যেন সমগ্র একটা যুগ ও কালপ্রবাহকে ভাষায় লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ-ধরনের বিষয়বস্তুতে অসংলগ্নতার ভয় তো থাকেই, কিন্তু কুসুম খেমানী তাঁর সৃজনশীল কুশলতা দিয়ে যেভাবে ভাষাকে বিন্যস্ত করেছেন, তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এ গ্রন্থ হিন্দি ভাষায় একটি উপন্যাস তো বটেই, কিন্তু এর ভাষাবিন্যাস বাংলা ও রাজস্থানি শব্দসমূহকে এত চমৎকারভাবে সন্নিবদ্ধ করে তুলেছে, যা কখনোই মনে হয় না যে করে লেখা। সাধারণভাবে, হিন্দি উপন্যাসগুলিকে এক ধরনের লোকভাষা বা প্রান্তিক ভাষার শব্দ ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কিন্তু এখানে যে লিখন ভাষা তৈরি করা হয়েছে, তাকে এক কথায় বলা যেতে পারে ‘উপভোগ্য’। সেদিক দিয়ে এই উপন্যাস হিন্দি ভাষায় একটা বিচিত্র স্বাদের হয়ে উঠেছে। স্বীয় জীবনের উত্তরার্ধে পৌঁছে লাবণ্যদেবী যে-প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন, সেটা মুক্তির প্রশ্ন; কিন্তু সেই মুক্তি নিজের কাছে বা নিজের প্রিয়জনের কাছেও সীমিত থাকছে না, বরং আরো এগিয়ে মানুষ মাত্রেরই মুক্তিতে রূপান্তরিত হতে লক্ষ করা যায়। লাবণ্যদেবীর ব্যক্তিত্ব কর্ম ও সংগ্রামের উপাদান দিয়েই তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু সেসব উপাদান নিরেট ও নিশ্চল না হয়ে সর্বোচ্চ মূল্যবোধের উত্তাপে দ্রবমান হিসেবেও লক্ষণীয়। তিনি যে বার্তা স্বীয় সন্ততিদের কাছে পৌঁছে দিতে চান, সেটা হচ্ছে, অবিরাম সংগ্রাম ও কর্ম। এই যে 'কর্ম'—এর স্বীকৃতির কারণেই লাবণ্যদেবী নিয়তিকে বাতিল করে দেন, এবং যেখানে সেটা করে উঠতে পারেননি, সেখানেও তিনি মাথা নোয়াননি। লাবণ্যদেবীর কর্মনিষ্ঠ জীবন ও তাঁর সমস্ত সিদ্ধান্ত জনকল্যাণের জন্যই কৃত। এই উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিত উচ্চবিত্ত শ্রেণির হওয়া সত্ত্বেও, এর মধ্যে বিধৃত মূল্যবোধের জন্য বিস্তৃত পাঠকসমাজে তার প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে পারবে।