ভূমিকা এই গাঙ্গেয় বদ্বীপে আর্যদের আগমনের পূর্বে অন্তত আরো চারটি জাতি ছিল। নেগ্রিটো, অস্ট্রো-এশিয়াটিক, দ্রাবিড় ও ভোটচীনীয়। এদেশে নিগ্রোদের মতো দৈহিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন স্বতন্ত্র এক আদিম জাতির বসবাসের কথা অনুমান করা হয়। প্রায় সাড়ে পাঁচ কি ছয় হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে আসাম হয়ে অস্ট্রো-এশিয়াটিক বা অস্ট্রিক জাতি বাংলায় আগ্রাসন চালিয়ে নেগ্রিটোদের উৎখাত করে। এরাই কোল, সাঁওতাল, মুণ্ডা, পাহান প্রভৃতি আদিবাসীর আদি পুরুষ। অস্ট্রো-এশিয়াটিক জাতির আমলে কিংবা কিছুটা পরে দ্রাবিড় জাতি এদেশে এসে অস্ট্রো-এশিয়াটিক জাতিকে করে ফেলে। অস্ট্রো-দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণেই আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। ধারণা করা হয় বাঙালিদের তিন-চতুর্থাংশের বেশি অংশই এ প্রাক-আর্য জনগোষ্ঠী। আর্যদের পর এদেশে মঙ্গোলীয় বা ভোটচীনীয় জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটে। কিন্তু বাংলার মানুষের রক্তের মধ্যে তাদের রক্তের মিশ্রণ খুব বেশি নয়। বাংলার উত্তর ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তে এদের অস্তিত্ব রয়েছে। গারো, কোচ, ত্রিপুরা, চাকমা প্রভৃতি আদিবাসী এ গোষ্ঠীভুক্ত। কালের বিবর্তনে আদিবাসীরা আজ সংখ্যালঘু। সংখ্যাগুরুদের প্রভাব ও নিপীড়নে তাদের অস্তিত্বই সংকটাপন্ন। লুপ্ত হচ্ছে তারা, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। হাজার হাজার বছর ধরে যেসব বিশ্বাস ও আচার প্রচলিত ছিল আদিবাসী সমাজে, হারিয়ে যাচ্ছে সেগুলোও। সেসব বিশ্বাস ও তার অন্তরালের গদ্য যেমন অভিনব, তেমনি বিস্ময়করও। আবার আদিবাসী সমাজে প্রচলিত উৎসবের পেছনে তাদের বিশ্বাসের গদ্যগুলোও অনন্য, যা সমৃদ্ধ করেছে আদিবাসী সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে। এ গ্রন্থে আদিবাসী গ্রাম ঘুরে ঘুরে তুলে আনা হয়েছে কড়া, সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহালি, ডালু, তুরি, মুণ্ডা, গারো, ম্রো, রাখাইন রাজবংশী, মণিপুরি, হাজং, চাক, মুসহর, খুমি, চাকমা, ভুনজার, ত্রিপুরা, লোহার, মারমা, পাহাড়িয়া, কোচ, খাসিয়া, মাহাতো প্রভৃতি আদিবাসী সমাজে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত লোককথাগুলো। আদিবাসী বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে অনেক আদিবাসী গ্রামে গিয়ে খুব কাছ থেকে তাদের আচার-উৎসব দেখার ও আলোকচিত্র তোলার সুযোগ ঘটেছে। আন্তরিকতার সঙ্গে লোককথার নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আদিবাসী জগেন কড়া (ঝিনাইকুড়ি, হালজায়, দিনাজপুর), সুমনা চিসিম (আচকিপাড়া, হালুয়াঘাট, ময়মনসিংহ), মতিলাল হাজং (বিরিশিরি, নেত্রকোনা), লবানু শিং (তুরিদের গ্রামপ্রধান, লোহাডাঙগা, দিনাজপুর), টেম্পু পাহান (উত্তর গোদাবাড়ী, দিনাজপুর), রনজিত সরকার (গোলাই গ্রাম, গোদাগাড়ী, রাজশাহী), মুংলি টিরকি ও বাতাসু ভুনজার (কালিয়াগঞ্জ, দিনাজপুর) প্রমুখ। তাঁদের কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। এ গ্রন্থটি করার বিষয়ে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন বন্ধুবর আবদুর রাজ্জাক। তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা। আদিবাসী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দুই কন্যা পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা বাবাকে কাছে পেয়েছে খুব অল্প সময়ের জন্য। সব সময় পাশে থেকেছে সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমিও। এই গ্রন্থের প্রায় প্রতিটি লেখার প্রথম পাঠক সে। লেখালেখি ও গবেষণাকাজে মূল প্রেরণা ও শক্তি আমার পরিবার। আদিবাসী লোককথা গ্রন্থটি যত্নসহকারে ও গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করার দায়িত্ব নেওয়ায় আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী, বেঙ্গল পাবলিকেশনসের কর্ণধার ও প্রকাশক, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের প্রতিও।
লেখক ও গবেষক। জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটা বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। তাঁর রচিত যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে ‘তরুণ কবি ও লেখক কালি ও কলম’ পুরস্কার লাভ করে। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।