মন ভরানো ও মন জাগানো একগুচ্ছ গল্প এ বইয়ের গল্পগুলো মূলত শিক্ষামূলক। শিশুকিশোরদের সুকুমার মনের অনুভূতিগুলো চিনিয়ে দেবার মাধ্যমে ওদের মানসিক বিকাশ ঘটানোই মূল উদ্দেশ্য। বলা বাহুল্য, এসব গল্প আমার কোনো মৌলিক লেখা নয়। বলতে গেলে সব গল্পই অতি পরিচিত এবং প্রচলিত। স্কুলে মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীর মধ্যেকার মানবিক গুণের বিকাশ, কল্পনাশক্তির জাগরণ, সাহিত্যভাষা ও নির্মাণশৈলি ইত্যাদির সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়ার জন্য ‘দ্রুতপঠন’ বা ‘বাংলা সহপাঠ’ নামে একটি বই পাঠ্য করা হয়। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত এই বইগুলো শিক্ষার্থীদের বয়স অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন কারিকুলাম অনুসরণ করে রচনা করা হয়। সেসব কারিকুলামে বিশ্বসাহিত্য, দেশীয় সাহিত্য, লোককাহিনি, নাটক, উপকথা, নীতিগল্প ইত্যাদি মিলিয়ে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক একটা সিলেবাস দিয়ে দেওয়া হয়। লেখক বা সম্পাদক সে অনুসারে গল্প, কাহিনি নির্বাচন করে শ্রেণী অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে পুনর্নিমাণ করেন। এ গল্পগুলোও সে উদ্দেশ্যেই রচিত হয়েছিল। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণীর জন্য মূল গল্প, প্রচলিত কাহিনি, উপকথা ইত্যাদি অবলম্বনে পুনর্লিখিত, রূপান্তরিত বা নবায়িত করে লেখা আমার তিনটি বই থেকে দশটি গল্প বাছাই করে এ বইয়ে প্রকাশ করা হলো। অবশ্য স্কুল পাঠ্য বইয়ের জন্য শব্দসংখ্যা পৃষ্ঠাসংখ্যা ইত্যাদি বাধ্যবাধকতা থাকায় তখন গল্পের কলেবরের সংক্ষিপ্ততার দিকে নজর রাখতে হয়েছে। এখন এখানে গল্পগুলো পুনঃসম্পাদনা করে প্রয়োজনীয় বিস্তার, ও ভাষাগত সৌন্দর্য বিধানের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে অবশ্যই তা মূল কাহিনির বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখে। এ বইয়ে গ্রীক কবি হোমারের ইলিয়াডের কাহিনি, ইংরেজ কবি শেকসপিয়ারের দি টেম্পেস্ট নাটকের গল্প, আইরিশ লেখক অস্কার ওয়াইল্ডের গল্প দ্য সেলফিশ জায়ান্ট-এর কাহিনি যথাক্রমে ‘ট্রয়ের যুদ্ধ ও বীর হেক্টর’, ‘নির্জন দ্বীপে প্রসপারো’ এবং ‘হিংসুটে দৈত্যের বাগান’ শিরোনামে সংক্ষেপে কিশোর উপযোগী ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে। মনসুর বয়াতির মৈমনসিংহ গীতিকার একটি দীর্ঘ করুণ লোককাহিনি দেওয়ানা মদিনা আখ্যানকে নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে ‘আলাল ও দুলাল’ গল্পে। পৃথিবীতে যুগে যুগে বহু রাজরাজড়া শাসক কিংবা বীর যোদ্ধার জন্ম হয়েছে। তাঁদের ঘিরে তৈরি হয়েছে নানারকম গল্প, কাহিনি, কিংবদন্তি। এসব গল্পে ঐতিহাসিক সত্যতা পুরোপুরি না থাকলেও লোকমুখে প্রচলিত কাহিনিগুলোর মধ্য দিয়ে কোনো একটি অঞ্চলে সে সময়ের জনমানস ও সমাজের পরিচয় পাওয়া যায়। বারোভূঁইয়াদের অন্যতম প্রতাপশালী স্বাধীন জমিদার ঈশা খাঁ, বাগদাদের মহানুভব খলিফা হারুনর রশীদ, ইরাকের দানশীল ব্যক্তি হাতেম তাঈ, পারস্যের জাবুলিস্তানের শাসক বীর রুস্তম এঁদের ক্ষমতা, মহানুভবতা, প্রতাপ সবকিছুই সাধারণ মানুষের কাছে ছিল রোমাঞ্চকর, বিস্ময়কর। তাই তাঁদের ঘিরে তৈরি হয়েছে অনেক কল্প-গল্পকথা। সেসবের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে নানা মানবিক গুণের কথা। সততা, মহত্ত্ব ও আদর্শের কথা। এ গল্পগুলো তাই বহুকাল ধরে মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। ‘ঈশা খাঁ-র বীরত্ব’, ‘একদিনের সিংহাসন’, ‘হুসনাবানুর দুসরা সওয়াল’, ‘সোহরাব রুস্তম’ গল্পগুলো সেসব কাহিনি চয়ন করেই পুনর্লিখিত হয়েছে। ‘বোকা রাজার আদুল গা’, আর ‘লোভের পরিণাম’ উপকথাভিত্তিক গল্প। এক পোশাকপাগল রাজার কাহিনি ‘বোকা রাজার গল্প’। এটি একটি স্যাটায়ারধর্মী শিক্ষামূলক গল্প। আত্মসুখে মগ্ন শাসকের অন্তঃসারশূন্যতা একসময় প্রকাশিত হয়ই, উলঙ্গ রাজা তা-ই প্রমাণ করে দেয়। আর ঈশপের গল্পগুলো তো সবারই জানা। ‘লোভের পরিণাম’ শিরোনামে বাঘ শেয়াল আর খরগোশের গল্পটাকে শুধু আমি স্বাদু ভাষায় উপভোগ্য করে বলার চেষ্টা করেছি। সব গল্পেই ভাষার দিকে নজর দিয়েছি। তা যেন শিশুকিশোর উপযোগী হয়। সহজ আর সাবলীল হয়। তবে ইতিহাস, ট্র্যাজেডি, মহাকাব্য এসবের ভাষার একটা বৈশিষ্ট্য আছে, সেটি হলো গাম্ভীর্য। সে গাম্ভীর্যকে পুরোপুরি তুলে দিলেও চলে না। তা হলে ভাষার শক্তি বোঝার জন্য শিশুকিশোরদের মেধার উন্মেষও ঘটবে না। মেধাকে উদ্দীপ্ত করার জন্য মহৎ সাহিত্যের ভাষার সাথে কিছুটা হলেও তাদের পরিচয় ঘটানো দরকার। সেদিকটাতেও লক্ষ্য রাখতে হয়েছে। সব মিলিয়ে এ বইয়ের পাঠকের জন্য একগুচ্ছ বিচিত্র বিষয়ের ভালো ও মজার গল্প রইলো যা একই সঙ্গে মন ভরানো ও মন জাগানো। ঝর্না রহমান ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ঢাকা ১২২৯
চল্লিশ বছর ধরে লেখালেখির সাথে যুক্ত আছেন। ১৯৮০ সনে বাংলাদেশ পরিষদ আয়োজিত একুশে সাহিত্য প্রতিযোগিতায় ছোটগল্পে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ। গল্প উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নাটক, কবিতা, ভ্রমণ-শিশুসাহিত্য, সবক্ষেত্রেই তাঁর বিচরণ। গল্পকার হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৬০টি। পেশাগত জীবনে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেলস পাবলিক কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। বেতার ও টেলিভিশনের নিয়মিত কণ্ঠশিল্পী। বাংলা ভাষার কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০২১ সালে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার-১৪২৭ লাভ করেন। জন্ম ২৮ জুন, ১৯৫৯, গ্রামে বাড়ি : কেওয়ার, মুন্সিগঞ্জ।