সাহাবীদের জীবন কথা… ________________________________________একদিন এক ছোট্ট সাহাবী রাসূল সা. কে অজুর পানি এগিয়ে দিলে রাসূল সা. খুব খুশী হন আর সেই সাহাবীর জন্য দুয়া করেন এই বলে… “হে আল্লাহ! তুমি তাকে দ্বীনের উপর বিশেষজ্ঞ বানিয়ে দাও এবং তাকে কুরআনের রহস্য বোঝার যোগ্যতা দান করো।” মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীর এ দুয়া কবুল করেন এবং সেই সাহাবীকে অনেক অনেক জ্ঞান দান করেন। অসাধারণ মেধাবী এবং আলোকিত জ্ঞানী এ সাহাবীর নাম আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.। অগাধ জ্ঞান ও পান্ডিত্যের জন্য তিনি ‘বাহরুল ইলম’ (পূণ্যবান জ্ঞানী) উপাধি লাভ করেন। কুরআনের ব্যখ্যায় তিনি ছিলেন ভীষণ পারদর্শী।। কুরআনের রহস্য উপলব্ধির ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অনন্য। অসম্ভব প্রখর স্মৃতিশক্তি ছিলো তাঁর। আব্দুল্লাহর রা. জন্ম রাসূল সা. এর মদীনায় হিজরতের তিন বছর পূর্বে। আবদুল্লাহ ছিলেন রাসূল সা. এর চাচাতো ভাই। আর আব্দুল্লাহর মা উম্মুল ফাদল ছিলেন মহিলাদের মধ্যে ২য় ইসলাম গ্রহণকারী। তাঁর জন্মের পর তাঁর মা তাঁকে রাসূল সা. এর কাছে নিয়ে আসেন এবং রাসূল সা. খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিয়ে দেন। জন্মের পর থেকেই তিনি ইসলামিক এনভায়রনমেন্টে বড় হতে থাকেন। তাঁর বাবা মক্কা বিজয়ের কিছুদিন পূর্বে ৮ম হিজরিতে ইসলাম গ্রহণ করেন। আর তখনই তারা সপরিবারে মদীনায় হিজরত করেন। আবদুল্লাহর বয়স তখন এগারো। আব্দুল্লাহ রাসূল সা. কে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। রাসূল সা. এর মৃত্যুর সময় আব্দুল্লাহর বয়স ছিলো মাত্র ১৩ বছর। খুব অল্প সময় তিনি রাসূলকে কাছে পেয়েছিলেন। এটুকু সময়ের ভেতরও তিনি জ্ঞানের গভীরতায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই বয়সেই তিনি রাসূলুল্লাহর ১,৬৬০ টি হাদীস স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেছেন। যা মুসলিম জাতির কল্যাণ সাধনে রাখছে বিরাট ভূমিকা। কী অসম্ভব ট্যালেন্টেড ছিলেন তিনি! আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করতেন। সুযোগ পেলেই রাসূলের সেবা করতেন। রাসূল সা. এর একটু সঙ্গ পাওয়ায় জন্য সবসময় অস্থির হয়ে থাকতেন। রাসুলুল্লাহ সা. এর স্ত্রী উম্মুল মু’মিনীন মাইমুনা রা. ছিলেন আবদুল্লাহর খালা। প্রায়ই তিনি তাঁর খালার বাসায় থাকতেন। এ কারণে খুব কাছ থেকে তিনি রাসূলের সাহচর্য লাভ করেছেন। কখনো তাঁর সাথে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেছেন… কখনো বা অজুর পানি এগিয়ে দিয়েছেন। রাসূল সা. এর ইন্তেকালের পর আবদুল্লাহ সাহাবাদের থেকে জ্ঞান লাভের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। তিনি বলেছেন, “কখনো আমি একটি বিষয় সম্পর্কে জানতে ৩০ জন সাহাবাকে প্রশ্ন করেছি।” কী প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা ছিলো তাঁর জ্ঞান লাভ করার! জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে ইবনে আব্বাস ছিলেন খুব বিনয়ী। জ্ঞানীদের তিনি অসম্ভব সম্মান করতেন। জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে তিনি যে কতো বিনয়ী ও কষ্ট সহিষ্ঞু ছিলেন তা তাঁর একটি বর্ণনা থেকেই অনুমান করা যায়। ইবনে আব্বাস বলেন, “আমি যখনই জানতে পেরেছি রাসূল সা. এর কোনো সাহাবীর কাছে তাঁর একটি হাদীস সংরক্ষিত আছে, আমি তাঁর ঘরের দরজার কাছে গিয়েছি। যখন দেখেছি এখন দুপুরের রেস্ট করার সময় তখন দরজার বাইরে অপেক্ষা করেছি। বাতাসে ধূলাবালি উড়ে আমার জামা আর শরীর একাকার হয়ে গেছে। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আমার এ দূরবস্হা দেখে বলেছেন, ‘আবদুল্লাহ! রাসূলুল্লাহর চাচাতো ভাই! আপনি কি উদ্দেশ্যে এসেছেন? আমাকে খবর দেননি কেন, আমি নিজেই গিয়ে দেখা করে আসতাম।’ আমি বলেছি, আপনার কাছে আমারই আসা উচিত। কারণ জ্ঞান এসে গ্রহণ করার জিনিস, গিয়ে দেয়ার জিনিস নয়। তারপর আমি তাঁকে হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি।” জ্ঞান অন্বেষণে ইবনে আব্বাসের আগ্রহ, একাগ্রতা ও কর্মপদ্বতি দেখে সে যুগের বড় বড় জ্ঞানী ও মনীষীরাও চরম বিষ্ময় বোধ করেছেন। আবদুল্লাহ রা. এর কথা শুনে মানুষ বিমোহিত হতো। কেউ তাঁর কাছে কোনো কথা বলতে আসলে তিনি তা আগ্রহ ভরে শুনতেন। তাঁর বাসাটি ছিলো একটি ইউনিভার্সিটি। সেখানে তিনিই ছিলেন একমাত্র টিচার। সপ্তাহে এক এক দিন এক এক বিষয়ে লেকচার দিতেন। ফিকহ, হালাল-হারাম, ফারায়েজ, কবিতা, সাহিত্য, প্রাচীন আরবের ইতিহাস এসব বিষয় থাকতো তাঁর আলোচনায়। তাঁর আলোচনা শুনে সবাই পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরতেন। আবদুল্লাহ রা. এর অপরিসীম জ্ঞান ও চিন্তা শক্তির কারণে অল্প বয়সী হওয়া সত্ত্বেও উমর রা. ও উসমান রা. এর শাসনামলে মজলিশে শূরার (পরামর্শ সভা) সদস্য ছিলেন তিনি। দ্বীনি জ্ঞানে গভীর পাণ্ডিত্যর জন্য উমর রা. জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতেন। উমর রা. আবদুল্লাহ রা. কে দেখলেই বলতেন, “ঐ যে বিচক্ষণ ও বিবেকবান যুবক আসছে!” তাঁর চরিত্রে ছিলো তাকওয়ার প্রতিচ্ছবি। তিনি ছিলেন দিনে রোজাদার এবং রাতে ইবাদতকারী। রাতের একটি অংশ তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে কাটাতেন এবং তাওবা ইসতিগফার করতেন। আল্লাহর ভয়ে তিনি এতো বেশি কাঁদতেন যে চোখের পানি তাঁর দু’গালে দুটি রেখার সৃষ্টি করেছিলো। প্রিয় নবীর দুয়া ও জ্ঞান অর্জনের জন্য আবদুল্লাহ রা.এর অক্লান্ত চেষ্টা তাঁকে জ্ঞানের গভীরতায় পৌঁছতে সাহায্য করেছে। তাঁর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়েছে চারদিক… তাঁর বর্ণনা করা হাদীসগুলো আজো মানুষের হেদায়েতের আলোকবর্তিকা! ৭১ বছর বয়সে তায়েফ নগরে ইন্তেকাল করেন তিনি। তায়েফে ‘মসজিদ ইবনে আব্বাস’ নামক মসজিদটি আজো তাঁর স্মৃতি বহন করে চলেছে। এ মসজিদেরই পেছনের দিকে রয়েছে এ মহান সাহাবীর কবর।