শিল্প মানেই সৌন্দর্য সৃষ্টি। সৌন্দর্যের থাকে উপভোগ্যতা। রন্ধনও এক অনুপম শিল্প। এই শিল্পজাত দ্রব্যটি শুধু ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য স্বাদে-সৌরভে রসনাকেই প্রলুব্ধ করে না, বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে-গীতিতে হৃদয়েও দোলা দেয়। রান্নাঘরটি বসতবাড়ির সবচেয়ে অবহেলিত জায়গা হলেও এখানে লিখিত হতে থাকে সমাজসভ্যতা সংস্কৃতির নানা ইতিহাস। খাদ্যবস্তুর সাথে সেই ইতিহাসের বন্ধন আর সৃজনের নন্দনকলা নিয়ে কয়জন ভাবেন? রন্ধনের নন্দনপিপাসু লেখক দিলারা মেসবাহ তাঁর ‘রন্ধন বন্ধন নন্দতত্ত্ব’ বইটিতে রান্নাবান্না খানাখাদ্যকে আশ্রয় করে যেন এক দারুণ রসুইখানা খুলে বসেছেন। কিন্তু সেখানে নেই প্রথাগত কোনো ‘পাক প্রণালী’, বরঞ্চ লেখকের ইতিহাস ঐতিহ্য নৃতত্ত্ব সংস্কৃতি জাতিসত্তা বিষয়ক গভীর প্রজ্ঞা, বিস্তৃত পাঠঅভিজ্ঞতার আঁচড়ে, সাবলীল সরস গদ্যের বয়ানে হয়ে উঠেছে ভিন্নধর্মী রচনাশৈলীর এক দুর্দান্ত গ্রন্থ। এ বইয়ের পাতায় পাতায় রসজ্ঞ পাঠকের জন্য আছে নানারকম স্বাদু খোরাক। বাঙালির খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যরুচি একদিনে গড়ে ওঠেনি। বাঙালি জাতিসত্তার সাথে মিশে আছে নানা জাতি ধর্ম ভাষা ও সংস্কৃতির মিশ্রণের সহস্রাধিক বৎসরের ইতিহাস। লেখক অত্যন্ত মুনশিয়ানার সাথে সেই ইতিহাস ঐতিহ্যকে এ বইয়ে তুলে এনেছেন। ভিন্ন ভিন্ন আকর্ষণীয় শিরোনামে বিভক্ত করে প্রতি বিভাগে নানারকম অন্নব্যঞ্জন ঝালঝোল পিঠাপায়েশের খবর দিয়েছেন এক অননুকরণীয় বয়ানে। মোগল সম্রাটদের মদ্যধৌত মাংস রন্ধন গল্প থেকে ঠাকুরবাড়ির খাদ্যরুচি হয়ে বাংলাদেশের আদিবাসীর রন্ধনশালা, চর্যাপদের ডোম্বীর কুড়ে থেকে প্রকৃতপৈঙ্গল হয়ে বৈষ্ণব কাব্যের রাধার আকুল মনের ব্যাকুল রান্না, মঙ্গলকাব্যের ঈশ্বরী পাটনি থেকে সৈয়দ মুজতবা আলী হয়ে জীবনানন্দ দাশ, বেগম রোকেয়া থেকে লেখকজননী- বাঙালির রন্ধনঘরের নন্দনতত্ত্ব আবিষ্কারে দিলারা ডুবুরীর মতো বাংলা কাব্য সাহিত্যের অতলে ডুব দিয়ে মুক্তা তুলে এনেছেন। প্রতিটি খাদ্যের সাথে পরিবেশন করেছেন বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক রাজনৈতিক সামাজিক ইতিহাস, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, লৌকিক, রাজসিক, গ্রামীণ, নাগরিক জীবনাচার থেকে অজস্র চয়ন, অসংখ্য মনোজ্ঞ উদাহরণ। বাংলাদেশের চৌষট্টি জেলা থেকে ঐতিহ্যবাহী নানারকম খাবারের বয়ান দিয়ে পাঠকের রসনাকেই শুধু উস্কে দেননি, অনবদ্য স্বাদু গদ্যের বিবরণে পাঠ অভিজ্ঞতাতেও যুক্ত করেছেন নতুনতর আস্বাদ। লেখকের বুদ্ধিদীপ্ত সরস ভাষা এ বইটিকে অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। রন্ধন যে প্রকৃতই একটা শিল্প, তার স্তরে স্তরে লুকিয়ে থাকে কতশত উদ্ভাবনী চিন্তা, সৃজনশীলতা, রুচি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজপ্রবহমানতার তথ্য ও তত্ত্ব খাদক তার সন্ধান করেন না, করেন শিল্পরসিক গবেষক আর নন্দনতত্ত্বের অনুসন্ধানীজন। দিলারা মেজবাহ সেই শিল্পবোদ্ধা অনুসন্ধানী লেখক। অজস্র রন্ধন গল্প আর বাঙালির খাদ্যরুচির সাথে সংশ্লিষ্ট অজস্র অন্নব্যঞ্জনের শিল্পিত সম্ভার নিয়ে দিলারা মেসবাহর এক অভিনব গ্রন্থ রন্ধন বন্ধন নন্দনতত্ত্ব। এ বই আমাদের বইয়ের ভুবনে একটি বিশেষ সংযোজন হবে বলেই বিশ্বাস। ঝর্না রহমান