৭ মার্চ। শুক্রবার। হঠাৎ তোমার আবির্ভাব। সঙ্গে একরাশ দাবি। গল্প শোনাতে হবে। অগ্নিযুগের গল্প। মানতেই হবে। কারণ দাবিটা তোমার। কিন্তু একটা কথা। অগ্নিযুগের কত গল্পই তো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। সেই অতুলনীয় বীরত্ব, সেই নিঃশেষ আত্মবিসর্জন, এর কি শেষ আছে কোথাও! তার মধ্যে কোন্টা ছেড়ে কোন্টা তোমাকে শোনাব বলো তো? ঠিক আছে। তুমি তো একালের একজন নামি গায়িকা। বিশেষ করে গানের জলসায় তো আজকাল তুমি ছাড়া কোনো কথাই নেই। আমি বরং তোমাকে অগ্নিযুগের কয়েকটা জলসার কাহিনি শোনাচ্ছি কল্যাণী। একজন গায়িকা হিসেবে এ কাহিনিগুলো তোমার জানা উচিত। তাতে আর কিছু না হোক, সেকালের এবং একালের রুচি এবং চিন্তাধারার তফাতটা নিশ্চয়ই তোমার নজরে পড়বে। যাক, শোনো ‘র্স ফরোশী কি তমন্না অব্ হমারে দিল্ মে হ্যায়, দেখনা হ্যায় জোর কিত্না বাজুএ কাতিল মে হ্যায়।’ গানটি তুমি শুনেছ কী কল্যাণী? নিশ্চয়ই শোনোনি। অনেকদিনের পুরনো গান। না-শোনাটাই স্বাভাবিক। তবে তখনকার সময়ে কিন্তু এ গানটি হাটে, মাঠে, পথে, প্রান্তরে-সর্বত্র শোনা যেত। শোনা যেত সবার মুখে মুখে। আজ আর শোনা যায় না। ইতোমধ্যে অনেকদিন কেটে গেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। মানুষের চিন্তাধারারও পরিবর্তন ঘটেছে। তাই স্বাভাবিক কারণেই গানটি আজ হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির এক অতল গভীরে। হারিয়ে গেছে সেদিনের সব কিছুই। বোধহয় শেষবারের মতো গানটি শোনা গিয়েছিল মহানগরীর কোলাহল থেকে অনেক দূরে, অভূতপূর্ব এক গানের জলসায়। সে জলসা রঞ্জি স্টেডিয়াম, রবীন্দ্র সদন বা মহাজাতি সদনের মতো কোনো আলো-ঝলমল প্রাসাদোপম অট্টালিকাতে অনুষ্ঠিত হয়নি। বাংলা বা বম্বের (মুম্বাই) কোনো শিল্পী-সমাবেশও সেখানে ছিল না। কোন রাজ্যপাল বা মেয়রও সেখানে উপস্থিত ছিলেন না, তাঁদের বহুমূল্য বাণী-বিতরণের জন্য। ছিল না জাতীয় জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ, চিত্রতারকাদের অভাবনীয় সমাবেশ। তবু সে জলসার কোনো তুলনা নেই কল্যাণী। ভারতবর্ষ তো দূরের কথা, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো জলসা আর কোথাও অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এ জলসা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৪ সালের ১৩ মে, গয়া সেন্ট্রাল জেলে। এর নায়ক-বৈকুণ্ঠ সুকুল। পাশেই ছিলেন প্রাক্তন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার পঞ্চায়েত মন্ত্রি শ্রদ্ধেয় বিভূতি দাশগুপ্ত। অনুষ্ঠানের শিল্পী হিসেবে বিভূতিবাবুই এতদিন পরে সেই জলসার কাহিনি ব্যক্ত করেছেন দেশবাসীর কাছে। বিভূতিবাবুর পরে প্রখ্যাত বিপ্লবী নায়ক শ্রদ্ধেয় ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়। বিভূতিবাবুর সেই জলসার কাহিনিই আবার তিনি জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন নতুন করে। কারণ এ জলসা শুধু জলসা নয়, জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো এক মৃত্যুঞ্জীয় মূল্যবান জীবন-দর্শন। এ কাহিনি আজকের দিনের সংগ্রামী মানুষের কাছে বার বার তুলে ধরা উচিত। গয়া জেলে অনুষ্ঠিত সেই জলসার কাহিনি আমি সংগ্রহ করেছি তাঁদের লেখনি থেকেই। যাক, এবার শোনো- ১৯৩৪ সাল। আইন-অমান্য আন্দোলনে যোগ দেবার অপরাধে বিভূতিবাবু তখন গয়া সেন্ট্রাল জেলের পনেরো ডিগ্রি সেলে বন্দি। পাশের দুটি সেলে রয়েছে আরো দুজন বন্দি। রঘুনাথ পান্ডে ও ত্রিভুবন আজাদ। অপরাধ সেই একই। অর্থাৎ, আইন-অমান্য আন্দোলনে যোগ দেওয়া।