‘সায়েন্স ফিকশন’ (Science Fiction) সাহিত্যের একটা প্রকরণ, ফর্ম বা আঙিক। এই ইংলিশ শব্দ দুটির অর্থই এই প্রকরণের চরিত্র নির্দেশ করে। সায়েন্স অর্থ বিজ্ঞান, আর ফিকশন অর্থ আখ্যান বা কাহিনি। অর্থাৎ সায়েন্স ফিকশন এমন একটা সাহিত্য প্রকরণ যার মধ্যে বিজ্ঞান এবং আখ্যান দুটোই থাকবে। যেহেতু এটা সাহিত্য, সেহেতু ফিকশন বা আখ্যানই এখানে মুখ্য, বিজ্ঞানের ভূমিকা আধেয় বা বিষয় (content) হিসেবে। তবে সাহিত্যের অন্যান্য প্রকরণ থেকে এটা আলাদা এই বিজ্ঞানের কারণেই। সেজন্য বিজ্ঞানকে গৌণ ভাবারও কোনো কারণ নেই। সায়েন্স ফিকশনে বিজ্ঞানকে সাধারণত দূরকল্পী বা ভবিষ্যতের অগ্রসর বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ এই বিজ্ঞান কল্পিত বিজ্ঞান। তবে কল্পনাশ্রয়ী হলেও এই বিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় অতীত বা সমকালের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং ফর্মুলার ওপরে। এর ওপরেই একজন সায়েন্স ফিকশন লেখকের কৃতিত্ব অনেকখানি নির্ভর করে। তবে শুধু বিজ্ঞান থাকলেই সায়েন্স ফিকশনের চলে না। এটাকে আখ্যান হয়েও উঠতে হয়, অর্থাৎ আখ্যানের যেসব উপকরণ ও বৈশিষ্ট্য আছে তার সবকিছু এখানে থাকা চাই। উপযুক্ত প্রেক্ষাপট ও প্লট নির্মাণ, চরিত্র সৃষ্টি, সংলাপ, দ্বন্দ্ব-উত্তেজনা-জটিলতা, ইত্যাদি সবই থাকবে এতে। সায়েন্স ফিকশন কল্পনাশ্রয়ী বিজ্ঞান-নির্ভর গল্প-উপন্যাস হলেও তা মানুষের বাস্তব জীবনকে লক্ষ্যে রেখেই রচিত হয়। ইউরোপ-আমেরিকায় শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে বিপুল ও সর্বব্যাপক উন্নয়ন ঘটতে থাকে তার ফলে মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবন, এবং এমনকি নৈতিক ও মানসিক বিষয়গুলোও প্রভাবিত হয়। এর ভাল এবং মন্দ উভয় দিকই রয়েছে। মানবজীবনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই প্রভাব কতভাবে আসতে পারে, কতটা গভীর হতে পারে, তারই সাহিত্যিক প্রতিবেদন এই সায়েন্স ফিকশন। সুতরাং সায়েন্স ফিকশন আদৌ কোনো হালকা বা বিনোদনধর্মী রচনা নয়, বাস্তবে যদিও সেরকমটাই ভাবা হয়। আসলে অধিকাংশ সায়েন্স ফিকশন লেখক এই সাহিত্য প্রকরণটির মর্মার্থ বুঝতে পারেন না, তারা রূপকথা, ফ্যান্টাসি বা রহস্য গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে সায়েন্স ফিকশনকে গুলিয়ে ফেলেন, বা কেউ কেউ ‘পাঠকপ্রিয়’ হয়ে ওঠার জন্য বিনোদনকে মূল উপজীব্য করেন। সায়েন্স ফিকশনের অধিকাংশ পাঠকও এই একই ভুল ধারণার অনুসারী। এ কারণে সায়েন্স ফিকশন হয়ে উঠেছে তাৎক্ষণিক আনন্দ প্রদান ও লাভের উপকরণ। আমাদের দেশে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে সায়েন্স ফিকশন এখন আর সাহিত্য হিসেবেই বিবেচিত হয় না। বাংলাদেশের কোনো সাহিত্য সংকলনে সায়েন্স ফিকশনের জায়গা হয় না এজন্যেই। অথচ ইউরোপ-আমেরিকায় সব সংকলনেই একাধিক সায়েন্স ফিকশন সেরা সাহিত্যের মর্যাদায় অন্তর্ভুক্ত হয়। বাংলা ভাষায় লিখিত সায়েন্স ফিকশনের প্রধান দুর্বলতা হলো এগুলোর অধিকাংশই বিদেশী লেখার নকল, অনুকরণ ও অনুসরণ। আর যেগুলো মৌলিক সেগুলোর বেশির ভাগই সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে উঠতে পারে না। তার চেয়েও বড় সমস্যা, এগুলোতে বিজ্ঞানও তেমন একটা থাকে না। মোটের ওপর লেখাগুলো আনন্দদায়ীও হয় না। বর্তমান সংকলনটি সম্পাদনা করতে গিয়ে আমরা এসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। বর্তমান সংকলনের জন্য লেখা বছাই করতে গিয়ে আমরা তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে চেয়েছি। প্রথমত, নির্বাচিত লেখাকে সাহিত্যের ন্যূনতম মান অর্জন করতে হবে। বলা বাহুল্য, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অধিকাংশ লেখার ক্ষেত্রেই আমাদের এই চাহিদা পূরণ হয়নি। দ্বিতীয়ত, লেখায় দূরকল্পী বা ভবিষ্যতের অগ্রসর বিজ্ঞান বা অন্তত সমকালীন বিজ্ঞান থাকতে হবে। এটা আমাদের অধিকাংশ লেখায় রয়েছে। তৃতীয়ত, বাছাইকৃত লেখায় মানবজীবনের ওপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব এবং এই প্রভাব বিরূপ হলে তার সমাধানের উপায় সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক, সামাজিক বা নৈতিক দিকনির্দেশনা থাকবে। কিছু লেখায় সেটা রয়েছে, যদিও তা আশানুরূপ নয়। চতুর্থত, আমরা প্রধানত নবীন এবং উদীয়মান লেখকদের লেখাকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছি যাদের লেখা ও বই প্রকাশের সুযোগ কম। আমরা সেটাই করেছি যেন এসব লেখক লেখা অব্যাহত রাখতে উৎসাহিত হন ও অনুপ্রেরণা পান। পঞ্চমত, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল পাঠক সমাজের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি এবং তাদের বিজ্ঞানের নৈতিক ব্যবহারের প্রতি আগ্রহী করে তোলা, সর্বোপরি সাহিত্য পাঠের আনন্দ দান করা। এতে আমাদের সাফল্য কতটা তা নিরূপণ করা কঠিন, এই দায়িত্ব ভবিষ্যতের হাতে অর্পণ করাই যুক্তিযুক্ত হবে। এই সংকলন সম্পাদনায় সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেছেন স্নেহভাজন কবি ও প্রাবন্ধিক শাহাদাৎ সরকার। এজন্য, এ সুযোগে তাকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। এছাড়া এই গ্রন্থটি প্রকাশ করার ঝুঁকি গ্রহণ করার জন্য প্রকাশক মহোদয়কে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই ।
নাজিব ওয়াদুদের জন্ম ২০ জুলাই ১৯৬১, রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠ শ্যামপুর গ্রামে। স্থানীয় মাসকাটাদীঘি বহুমুখী হাইস্কুল থেকে এসএসসি, রাজশাহী সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে। এমবিবিএস পাশ করেন। বর্তমানে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেপুটি চিফ মেডিকেল অফিসার হিসাবে কর্মরত। প্রকৃত লেখালেখি শুরু ১৯৮১ সালে, যদিও হাতেখড়ি কৈশােরে, ছড়া দিয়ে কাক ও কারফিউ, মেঘভাঙা রােদ, আবাদ, দখল, পাখির কান্না, সুন্দরী মেয়েটির নাক বোঁচা, জীয়নকাঠি, আরাে দুটি খুন, খনন, মৃত্যুঞ্জয় মারা গেছে, পদ্মাবতী প্রভৃতি গল্প লিখে। ব্যাপকভাবে আলােচিত ও প্রশংসিত হন। উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ লেখেন। গত দেড় দশকব্যাপী ছােটগল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস অনুবাদ করে একজন দক্ষ অনুবাদক হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছেন। তিনি লিটল ম্যাগাজিন ‘নন্দন’ সম্পাদনা করেন। ইতােমধ্যে বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন।