সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লেখা শুরু করেছিলেন ছোটগল্প দিয়ে। ছোটগল্পের একটি বই আছে তাঁর, শিশু- কিশোরদের জন্য গল্পের বই দু’টি। পরে তিনি সরে এসেছেন প্রবন্ধে। কিন্তু পুরোপুরি সরেন নি, তাঁর প্রবন্ধেও গল্পের ধরণ, কৌতূহল ও অনানষ্ঠানিকতা রয়েছে যেন আলাপ করছেন, আপনজনের সঙ্গে। তাঁর প্রবন্ধে কখনো কখনো আমি আসে। সেই আমি আত্মজৈবনিক হয়েও নৈর্ব্যক্তিক, যেন চরিত্রে একটি, গল্পেত। বহুক্ষেত্রেই তাঁর আলাপের বিষয় হছে সাহিত্যে স্রষ্টা এবং ইতিহাসের ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তাঁরও চরিত্রে পরিণত হয়েছে। তাঁর প্রবন্ধে এসে সাহিত্যের পরিচিত নায়ক-নায়িকারাও নতুন হয়ে ওঠে। নতুনত্ব তাঁর সব লেখারই বৈশিষ্ট্য। এই নতুনত্বর কারিণ দু’টি। এক, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। দুই, উপস্থাপন অধ্যাপক চৌধুরীর প্রথম বইয়ের নাম অন্বেষণ (১৯৬৪) সালে। এর শিরোনামে যে আগ্রহ ও কৌতূখলের প্রশ্রয় রয়েছে সে দুটি তাঁকে কখনো পরিত্যাগ করে নি। বহু বিষয়ে তাঁর আগ্রহ, বহুমুখী কৌতূহল। ঘটনাকে দেখেন, কিন্তু সেখানে নিবন্ধ থাকেন না, তিনি চলে যেতে চান অভ্যন্তরে আপাততের অন্তরালে রয়েছে যে রহস্যাছন্ন ও জরুরী জগৎ সেখানে। চিরকালকে স্থাপন করেন সমকালে। লক্ষ্য করেন কোন কোন ধারায় সময় ও স্বার্থ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে। ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির সম্পর্কের টানাপোড়েন তাঁকে বিশেষ ভাবে ভাবিয়েছে। এই লেখকের একটি বইয়ের নাম দ্বিতীয় ভূবন। তাঁর সব রচনাতেই একটি স্বতন্ত্র ভুবন রয়েছে। যেটি অভিনব নয় নিশ্চয়ই, কিন্তু স্বতন্ত্র অবশ্যই। তিনি অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন; সাহিত্য, রাজনীতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস কিছুই তাঁর জন্য পরিত্যাজ্য নয়, কিন্তু তাঁর বকত্বব্যের মধ্যে একটি ঐক্য বতমান, সেটি দৃষ্টিভঙ্গির। তাঁর কোনো লেখাই তাৎক্ষণিক নয়। প্রত্যেকটির পেছনে থাকে নিবিষ্ট পঠন ও কৌতূহলী অন্বেষণ। লেখকের রচনারীতিতেও একটিা নিজস্বতা রয়েছে যার জন্য নাম লক্ষ্য না-করেও বলে দেওয়া যায় কোনটি তাঁর লিখা।তিনি যত্নের সঙ্গে লেখেন কিন্তু কখনোই স্বতঃস্ফূর্ততাকে বিসর্জন দেন না। এই সঙ্কলনের প্রবন্ধগুলো বিভিন্ন্ সময় লেখা তাঁর রচনালী থেকে সংগৃহীত। যেহেত তাঁর সব লেখাই স্বতন্ত্র, এরা তাই তাঁর অন্য রচনার বিকল্প নয়। তবু একটি নিবার্চনের আবশ্যকতা ছিল, যাতে পাঠক একসঙ্গে হাতের কাছে তাঁর বিভিন্ন ধরণের রচনার নিদর্শন পান। সে জন্যই এই নির্বাচন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (জন্ম. ১৯৩৬) পেশায় সাহিত্যের অধ্যাপক এবং অঙ্গীকারে লেখক। এই দুই সত্তার ভেতর হয়তো একটা দ্বন্দ্বও রয়েছে, তবে সেটা অবৈরী, মোটেই বৈরী স্বভাবের নয়। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, অবসরগ্রহণের পর ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রফেসর এমেরিটাস হিসাবে মনোনীত হয়েছেন। তিনি শিক্ষা লাভ করেছেন রাজশাহী, কলকাতা, ঢাকা এবং ইংল্যান্ডের লীডস ও লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখার কাজের পাশাপাশি তিনি ‘নতুন দিগন্ত’ নামে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। তার গ্ৰন্থসংখ্যা আশির কাছাকাছি। তার অকালপ্রয়াত স্ত্রী ড. নাজমা জেসমিন চৌধুরীও লিখতেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন।