সহিহ আল-বুখারি একটি প্রসিদ্ধ হাদীস বিষয়ক গ্রন্থ। এটি কুতুব আস-সিত্তাহ অর্থাৎ হাদীস বিষয়ক প্রধান ছয়টি গ্রন্থের অন্যতম একটি গ্রন্থ। পারস্যের স্বনামখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ইমাম বুখারি আল্লাহ তায়ালার রাসু হযরত মুহাম্মাদ (সা:) -এর বাণী সংবলিত এই গ্রন্থ’টি সংকলন করেছেন। বুখারি শরীফকে ইসলামি বিধি-বিধান বিষয়ে পবিত্র কোরআন মাজিদের পরে সবচাইতে নির্ভরযোগ্য প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২১৭ হিজরী সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি মক্কার হারাম শরীফে এই গ্রন্থ’র সংকলন শুরু করেন। দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২৩৩ হিজরী সনে এর সংকলনের কাজ সমাপ্ত হয়। স্বয়ং ইমাম বুখারী বলেছেন, আমি আমার সহিহ বুখারি সঙ্গে নিয়ে বসরা শহরে ৫ বছর অবস্থান করেছি এবং আমার কিতাব প্রণয়ের কাজ শেষ করি। আর প্রতি বছরই হজ্ব পালন করি এবং মক্কা হতে বসরাতে ফিরে আসি। তিনি ৬ লাখ হাদিস হতে যাচাই বাছাই করে সর্বসাকুল্যে ১৬ বছর নিরলস সাধনা করে এ প্রসিদ্ধ ও অসাধারণ হাদিস গ্রন্থখানা প্রণয়ন করেন। ইবনে আল সালাহ-এর হিসাব মতে: বুখারী শরীফে হাদীসের সংখ্যা ৭২৭৫। পৃথিবীর প্রায় দেড় শতাধিক ভাষায় এই গ্রন্থ’টি অনূদিত হয়েছে। মুসলিম জাহানের প্রতিটি জ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে এই গ্রন্থ’টির ব্যবহার অগ্রগণ্য, অতুলনীয় ও প্রসংশনীয়। বাংলাদেশেও দাওরা হাদীস, কামিল পর্যায়ের মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালসমূহের সংশ্লিষ্ট বিভাগে এই গ্রন্থ’টি পাঠ্যতালিকাভূক্ত। এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ’র অনুবাদ যথাযথ, সহজ-সরল, প্রাঞ্জল ও সহজলব্ধ হওয়া আবশ্যক। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ জ্ঞান পিপাসু পাঠকদের হাতে সহজে তুলে দেওয়ার নিমিত্তে একই বিষয়ের একাধিক হাদীস থেকে যাছাই-বাছাই করে বুখারী শরীফের ৭২৭৫ হাদীস থেকে ২০০০ হাদীস নিয়ে ‘তাজরীদুল বুখারী’ (সহীহ আল-বুখারীর একক হাদীস সংকলন) নামে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে। মূল বুখারী শরীফ থেকে গ্রন্থ’টি অনুবাদ করেছেন ড. মুহাম্মদ ছাইদুল হক, সম্পাদনা করেছেন প্রখ্যাত আলেম ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক (অব.) মাওলানা মুহাম্মদ মূসা এবং রিভিউ করেছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর (অব.) ড. মাওলানা আবদুল জলীল। তাঁদের অক্লান্ত শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমের ফলে এই গ্রন্থ’টি সফলভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। এ ব্যাপারে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। আশা করছি ‘তাজরীদুল বুখারী’ প্রথম খ- প্রকাশিত হবার পর ছাত্র-শিক্ষক, গবেষক ও সর্বস্তরের সচেতন পাঠকমহল তা বিপুল আগ্রহের সাথে গ্রহণ করবে এবং সর্বমহলে সমাদৃত হবে। আমরা এই গ্রন্থ’টিকে ভুলত্রুটিমুক্ত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। তারপরও যদি ভুলত্রুটি কারো নজরে ধরা পড়ে তাহলে আমাদের অবহিত করলে আমরা তা পরবর্তী সংস্করণে প্রয়োজনীয় সংশোধনের ব্যবস্থা নেব ইন্শাল্লাহ্। মহান আল্লাহ পাক আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা) -এর সুন্নাহ্ জানা ও অনুসরণ করে চলার তাওফিক দিন। আমীন!
মুহাদ্দিস শব্দের আভিধানিক অর্থ হাদিসবেত্তা। বলা হয়ে থাকে সকল মুহাদ্দিসের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ছিলেন মুহাম্মদ বিন ইসমাইল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরাহ বিন বারদিযবাহ। ১৯৪ হিজরী, ১৩ই শাওয়াল শুক্রবার খোরসানের বোখারাতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল বোখারী (র) এর বই সমূহ এর জন্যই তিনি স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। মুসলিম জগতে ইমাম বোখারী নামে অধিক পরিচিত তিনি। তাঁর পিতা ইসমাইল ইবনে ইব্রাহিম মুসলিম জগতের আরেক পরিচিত ব্যক্তিত্ব, যার ওঠা-বসা ছিলো হাদিসবীদ আল্লামা হাম্মাদ (রহঃ) এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহঃ) এর। অঢেল ধন-সম্পত্তির মালিকও ছিলেন তিনি। তাই খুবই অল্প বয়সে ইমাম বোখারী পিতাহারা হলেও কোনো সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। এর আরেক কারণ তাঁর মা। তাঁর মা ছিলেন এক বিদূষী ও পরহেজগার নারী। পুত্রকে তিনি সঠিক শিক্ষাটাই দিয়েছিলেন। তাই মাত্র ৬ বছর বয়সে বোখারী (রঃ) কোরআনের হাফিজ হন এবং এরপর হাদিস শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। ষোল বছর বয়সে হজ্জে গমন করে মক্কায় থেকে যান দক্ষ হাদিসবীদদের থেকে হাদিসের জ্ঞান নিতে। হাদিস সংগ্রহের আশায় ইরাক, সিরিয়া, মিশর, মদিনাসহ বহু অঞ্চলে ভ্রমণের পর ষোল বছর পর আবার বোখারায় ফেরত যান। ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন দানশীল। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিলো প্রখর। ফলে হাদিস শুনেই মনে রাখতে পারতেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি ছয় লক্ষ হাদিস মুখস্থ বলতে পারতেন, ক্ষুদ্র ত্রুটিও তার নজর এড়াতো না। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল বোখারী (র) এর বই সমগ্র বলতে আমরা বুঝি বুখারী শরীফ, যাতে স্থান পেয়েছে ইমাম বোখারী (রঃ) দ্বারা সংগ্রহকৃত সহীহ হাদিস। তার সংকলিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টিরও বেশি। শেষ বয়সে তিনি নিজ বাসভূম থেকে বিতাড়িত হন এবং সমরকন্দের খরতঙ্গ নামক স্থানে চলে আসেন। এ অঞ্চলেই তিনি ২৫৬ হিজরীর, ১লা শাওয়াল ইন্তেকাল করেন।