ভালো মানুষ হওয়ার জন্য সবার আগে প্রয়োজন আত্মার সংশোধন। আত্মার সংশোধন ছাড়া দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণ লাভ করা সম্ভব নয়। যার অন্তর সংশোধন হয়ে যায়, সে-ই প্রকৃত সফল। কিন্তু আত্মশুদ্ধির পথে রয়েছে নানান তরীকা। সঠিক তরীকা খুঁজে না পাওয়ার ফলে মানুষ অন্তরকে জীবন্ত করার বদলে মেরে ফেলে। কোন তরীকাটি সঠিক সাধারণ মানুষের জন্য তা খুঁজে বের করা অত্যন্ত কঠিন। এই কঠিন কাজটি সহজ করে দিয়েছেন অষ্টম শতাব্দীর মহান ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহিমাহুল্লাহ)। তিনি ছিলেন আত্মার অভিজ্ঞ চিকিৎসক। প্রায় ছয়শত বছর পূর্বে তিনি আত্মশুদ্ধি-বিষয়ে পৃথিবীর সেরা একটি কিতাব রচনা করেছেন, যার নাম মাদারিজুস সালিকীন। সচেতন মুসলিম মাত্রই এই বইটির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। পৃথিবীর অসংখ্য ভাষায় এই বইটি অনূদিত হয়েছে। হাজার হাজার বইয়ে এর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়। এটি আত্মশুদ্ধি-বিষয়ে রেফারেন্স-বুক হিসেবে সমাদৃত। আলহামদুলিল্লাহ, দীর্ঘ পরিশ্রমের পর বিখ্যাত এই বইটির প্রাঞ্জল অনুবাদ নিয়ে এসেছি আমরা। বইটি যত বেশি পড়া হবে, পাঠক তত বেশি উপকৃত হবে এবং নিজেকে আখিরাতের জন্য প্রস্তুত করতে উৎসাহ পাবে। লেখক বইটিতে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আত্মশুদ্ধির সঠিক পথ দেখিয়েছেন। আত্মশুদ্ধি অর্জন করার জন্য তিনি অর্ধশত মানযিলের বর্ণনা দিয়েছেন। এ রকম কিছু মানযিল হলো—তাওবা, আল্লাহভীতি, গভীর ধ্যানে মগ্ন হওয়া, আল্লাহর ওপর ভরসা করা, সবর, শোকর, উত্তম চরিত্র, আল্লাহর স্মরণ, আত্মসম্মানবোধ ইত্যাদি। আত্মশুদ্ধির পথে এই বইয়ের প্রতিটি মানযিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বইয়ে রয়েছে এক মানযিল থেকে আরেক মানযিলে সফর করার দিকনির্দেশনা। যে নির্দেশনায় বান্দা একের-পর-এক মানযিল পাড়ি দিয়ে হয়ে ওঠে আল্লাহওয়ালা।
আল্লামা ইবনু কাইয়্যিমিল জাওযীয়া (রহঃ) ছিলেন ইসলামী চিন্তাবিদ, ফকিহ, তাফসীরবিদ, হাদীসজ্ঞ এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের পণ্ডিত। তাঁর পূর্ণ নাম ছিল আবু আব্দুল্লাহ্ শামসুদ্দ্বীন মুহাম্মাদ বিন আবু বকর বিন আইয়্যুব আদ দিমাশকী। তিনি ৬৯১ হিজরী সালে দামেস্কে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর পিতা দীর্ঘ দিন দামেস্কের আল জাওযীয়া মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বলেই তাঁর পিতা আবু বকরকে قيم الجوزية কাইয়্যিমুল জাওযীয়াহ অর্থাৎ মাদরাসাতুল জাওযীয়ার তত্ত্বাবধায়ক বলা হয়। পরবর্তীতে তাঁর বংশের লোকেরা এই উপাধীতেই প্রসিদ্ধি লাভ করে। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমীয়া (রহঃ)-এর স্নেহধন্য শিষ্য ছিলেন এবং শাইখের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তাঁর সাথেই ছিলেন। এমনকি জিহাদের ময়দান থেকে শুরু করে জেলখানাতেও তিনি তাঁর থেকে আলাদা হননি। তিনি ইসলামী আকীদাহ, তাওহীদ, সুন্নাহ ও বিদআত-বিরোধী বিভিন্ন বিষয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তার মধ্যে তাওহীদ ও সুন্নাহের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং ইবাদত-বন্দেগীতে নিষ্ঠা ছিল অন্যতম। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:
"যাদুল মা‘আদ ফী হাদ্য়ী খাইরিল ইবাদ"
"মাদারিজুস সালিকীন"
"শিফাউল আলীল"
"তিবেব নববী" (চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর অনন্য অবদান)
তাঁর উস্তাদ বৃন্দ -
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) যে সমস্ত আলেম-উলামার কাছ থেকে তালীম ও তারবীয়াত হাসিল করেন, তাদের মধ্যে রয়েছেনঃ
শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়াহ (রহঃ)।
আহমাদ বিন আব্দুদ্ দায়িম আল-মাকদেসী (রহঃ)।
তাঁর পিতা কাইয়্যিমুল জাওযীয়াহ (রহঃ)।
আহমাদ বিন আব্দুর রহমান আন্ নাবলেসী (রহঃ)।
তাঁর ছাত্রসমূহ -
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) এর হাতে যে সমস্ত মনীষী জ্ঞান আহরণে ধন্য হয়েছিলেন, তাদের তালিকা অতি বিশাল। তাদের মধ্যে রয়েছেনঃ
বুরহান উদ্দ্বীন ইবরাহীম বিন ইবনুল কাইয়্যিম।
ইমাম ইবনে রজব (রহঃ)।
হাফিয ইমাম ইবনে কাছীর (রহঃ)।
তিনি একজন নিরলস সাধক, যিনি দীর্ঘ সময় ইবাদত করতেন, বিশেষ করে তাহাজ্জুদ ও কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন থাকতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ইলমী ও আধ্যাত্মিক খেদমত মুসলিম উম্মাহর জন্য অমূল্য দান হয়ে রয়েছে। ইবনুল কাইয়্যিম ৭৫১ হিজরী সনে মারা যান এবং দামেস্কের বাবে সাগীর গোরস্থানে তাঁর পিতার পাশে দাফন করা হয়।