বাঙালির প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি- সবেতেই তিনি। ১৯২৮ সালে প্রবাসীতে ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’। গ্রন্থাকারে, ১৯২৯ সালে। বাঙালির প্রত্যহের সূর্যের বয়স তখন ৬৮। আধুনিকতম দৃশ্যভাবনার পাশাপাশি এক নতুন রবীন্দ্রনাথের সাথেও পাঠকের পরিচয় ঘটে। কাব্যধর্মী এ উপন্যাসের পরতে পরতে, না থেকেও প্রবলভাবে উপস্থিত বিশ্বকবি, স্বনামেই। “পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি / আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।” আমরা দু’জন- অমিত রায় আর লাবণ্য। শিলংয়ে প্রথম দেখা। তার পরে প্রণয়, মান-অভিমান, বিচ্ছেদ। ঠিক যেন ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতির রূপ বদলানোর মতো। নিজের একমাত্র কাব্যোপন্যাসের সতেরোটি পরিচ্ছেদে, প্রথম বাঙালি নোবেলজয়ী নিপুণ তুলির টানে বুঝিয়ে দিয়েছেন চরিত্রের গতিপ্রকৃতি, আর বক্তব্যের শেষ ভার তুলে দিয়েছেন ছন্দোবদ্ধ ভাষাভঙ্গির উপর। আর এরই মাধ্যমে মহামহিম রবীন্দ্রনাথ নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন চির আধুনিক রূপে। আবির্ভাবের শতবর্ষ পরে তাই আজও তুমুল জনপ্রিয় ‘শেষের কবিতা’। যার উপস্থিতি, যাকে নিয়ে আলোচনা অনিবার্য থাকে স্কুল পড়ুয়াদের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে, কলেজ ক্যান্টিনে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছতলায়। বুদ্ধিজীবীদের সান্ধ্য আড্ডাতেও।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।