জীবনে আমরা সবাই সফল হতে চাই। কিন্তু সফলতার রহস্য কি, সেটা কি আমরা জানি? সেই উত্তর বের করতে গিয়ে বিখ্যাত লেখক স্টিফেন আর. কোভে তার বিখ্যাত “The 7 Habits of Highly Effective People” বইটিতে ৭ টি অভ্যাসের বিষয় তুলে ধরেছেন, যে ৭টি অভ্যাস আপনাকে সকলের মাঝে অনন্য করে তুলতে পারে। আজকে আমরা সেই ৭ টি অভ্যাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানবোঃ 1.Be Proactive: আচ্ছা, আমরা কি একটা বিষয় খেয়াল করেছি, যখন কোনো কাজে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন আমরা সাধারণত সেই সিদ্ধান্ত -ই দেই, যে সিদ্ধান্ত বেশিরভাগ মানুষ দিয়েছে। অর্থাৎ আমরা নিজে থেকে নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত দেই না। বেশিরভাগ মানুষ যে সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেয়, আমরা সেই সিদ্ধান্তকে চোখ বুঝে সমর্থন করি। এক্ষেত্রে আমরা ‘Reactive’ ভুমিকা পালন করি। কিন্তু এসব বিষয়ে আমাদের হওয়া উচিত ‘Proactive’। সফল মানুষ হওয়ার জন্য যে কতগুলো গুণ বা অভ্যাস থাকা আবশ্যক, তার মধ্যে বিশেষ একটি অভ্যাস হচ্ছে Proactive হওয়া। অর্থাৎ একজন মানুষের উচিত যেকোনো কাজে তার নিজস্ব মতামতের বিষয়টিকে তুলে ধরা। অন্যের সিদ্ধান্তকে অন্ধভাবে সমর্থন না করে, নিজের জ্ঞান, চিন্তা ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে নিজের সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করা। যদি অন্য কারো সিদ্ধান্ত উপযুক্ত মনে হয়, তবে সেই সিদ্ধান্তকে আরো বেশি ইফেক্টিভ করার জন্য কি করা যেতে পারে, সেই বিষয়টা নিয়েও অন্ততপক্ষে আমাদের ভাবা উচিত। Proactive হওয়ার এই অভ্যাস আপনাকে সকলের মাঝে একজন অনন্য মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করবে। 2. Begin with The End in Mind: প্রতিটা কাজকে আরো ইফেক্টিভ করার জন্য সেই কাজের ফলাফল সম্পর্কে আমাদের পূর্ব ধারণা রাখা প্রয়োজন। আমরা কোন উদ্দেশ্যে কি করছি, সেটা সম্পর্কে আমরা যেন সবসময় অবগত থাকি। আমরা যখন কোনো উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে কোনো কাজ শুরু করবো তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সেই কাজে একাগ্রতা বেশি থাকবে। কাজ চলাকালীন আমরা উপলব্ধি করবো, আমরা আমাদের উদ্দ্যেশ্য পূরনের দিকে আস্তে আস্তে অগ্রসর হচ্ছি। এই বিষয়টা আমাদেরকে মানসিকভাবে শক্তি যোগাবে। আর এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা প্রতিটা কাজেই সফল হব। 3. Put First Thing First: Urgent’ এবং ‘Important’ এই দুইটা শব্দ সম্পর্কে আমরা সবাই পরিচিত থাকলেও, কেন যেন আমাদের জীবনে শব্দ দুটোর যথার্থ প্রয়োগ করতে পারিনা। আমরা অনেক সময় বুঝতে পারিনা, কোন কাজটার আগে আমাদের কোন কাজটা করা উচিত। এতে করে আমরা অনেক প্রয়োজনীয় কাজ না করে অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যস্ত হয়ে সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে ব্যর্থ হই। কিন্তু একজন সফল মানুষ হওয়ার জন্য আপনাকে অবশ্যই কোন কাজকে কতটুকু প্রায়োরিটি দিতে হবে, সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা রাখতে হবে। প্রতিটা দিন শুরু করার পূর্বেই একটা ‘To Do’ লিস্ট করে ফেলতে পারেন। সেই দিনের যে কাজগুলো বেশি ইম্পর্টেন্ট বা আর্জেন্ট সেগুলোকে লিস্টের প্রথমে রাখবেন। লিস্ট ফলো করে প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন সম্পন্ন করবেন। 4. Think Win-Win: “আমাকে যদি জিততে হয়, তাহলে অন্যজনকে হারতে হবে।” এরকম একটা ভুল ধারণা আমাদের অনেকের মাঝেই আছে। এই ধারণা আমরা নিজেদের মধ্যে পোষণ করি বলেই আমরা সামনে অগ্রসর হতে পারিনা। কারণ এর ফলে ‘অন্যকে হারানোর বিষয়টা ‘ আমাদের কাছে বড় হয়ে উঠে। আমরা আমাদের জয়ের বিষয়টাতে ফোকাস না করে অন্যের পরাজয়টা আমাদের কাছে মূখ্য হয়ে উঠে। এতে করে আমাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা প্রকাশ করতে আমরা সক্ষম হইনা।আবার অনেক ক্ষেত্রে, অন্যের সফলতা আমাদের মাঝে হীনমন্যতার সৃষ্টি করে। আমাদেরকে এরকম চিন্তা ভাবনা থেকে বের হতে হবে। আমাদের প্রতিযোগীতা হবে আমাদের নিজেদের সাথেই।যেকোনো ক্ষেত্রেই আমরা কি আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করতে পেরেছি? যদি উত্তর হ্যা হয়, তাহলেই আমরা জয়ী, তাহলেই আমরা সফল। নিজেদের সফলতা পরিমাপ করার জন্য অন্য কোনো মানদন্ড ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজন নেই। 5. Seek First to Understand, Than to be Understood: আমরা অধিকাংশ মানুষই উত্তর দেওয়ার উদ্দেশ্যে অন্যের কথা শুনি। অপরজন কি বলতে চাচ্ছে, কি বুঝাতে চাচ্ছে, সেটা বুঝতে আমরা চেষ্টা করি না। এতে করে কোনো আলোচনায় ফলপ্রসূ হয় না। কিন্তু আমাদের উচিত, অন্যের কথা আগে মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং সে কি বোঝাতে চাচ্ছে সে বিষয়ে ভালভাবে অবগত হওয়া। এতে করে পরবর্তীতে আপনি যখন কথা বলবেন, তখন অপরজন আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং আপনি যা বোঝাতে চাইবেন, তা সে ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করবে। এভাবে প্রতিটি আলোচনা ফলপ্রসূ হবে। 6. Synergize: সফল ব্যক্তিদের একটি বিশেষ গুন হচ্ছে তারা সব কাজ সম্মিলিতভাবে করে। তারা টিমওয়ার্কে বিশ্বাসী। এক গবেষণায় দেখা গেছে একটি কাজ ১০ জন লোক ১ ঘন্টা করে আলাদা আলাদা সময়ে করলে যতটুকু সম্পন্ন হয়, ১০ জন লোক একসাথে ১ ঘন্টা পরিশ্রম করে সে কাজটি করলে আগের চেয়ে অনেক বেশি কাজ সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে সফলতার হার অনেক বেশি। তবে টিমওয়ার্কের ক্ষেত্রে সকল টিমমেটকে সমান কর্মক্ষম হওয়া প্রয়োজন। 7. Sharpen The Saw: এই অভ্যাসটা আত্মস্থ করা খুব-ই গুরুত্বপূর্ণ। শিব খেরার বিখ্যাত ‘You Can Win’ বইয়ে একটা গল্প পড়েছিলাম, অনেকটা এরকম – “জন নামে এক কাঠুরে একটি সংস্থায় ৫ বছর কাজ করার পরেও তার মাইনে বাড়েনি। সেই সংস্থা তখন বিল নামে এক নতুন কাঠুরেকে কাজে লাগাল এবং এক বছরের মধ্যেই তার মাইনে বাড়িয়ে দিল। জন ক্ষুদ্ধ হয়ে সংস্থার কর্তাদের কাছে ব্যাপারটা জানতে চাইল। তখন সংস্থার প্রধান কর্তা তাকে বলল, ‘পাঁচ বছর আগে তুমি যে পরিমান কাঠ কাটতে আজও তুমি তাই কাটছো। তুমি যদি তোমার কাঠ কাটার পরিমান বাড়াতে পারো, তবে তোমার মাইনে বাড়িয়ে দিব।” জন ফিরে গিয়ে কাজ আরম্ভ করল। কিন্তু অনেক বেশি সময় ব্যয় করে এবং আরো বেশি পরিশ্রম করেও সে আগের চেয়ে বেশি কাঠ কাটতে পারলো না। তখন সে সংস্থার কর্তার কাছে গিয়ে তার সমস্যার কথা বলল। সংস্থার কর্তা পরামর্শ দিল বিলের সাথে কথা বলতে। বিলের হয়ত কোনো কায়দা, কানুন বা স্পেশাল কোনো টেকনিক জানা আছে – এই ভেবে জন বিলকে জিজ্ঞেস করলো সে এত বেশি কাঠ কাটে কিভাবে? বিল উত্তর দিল, প্রতিটি গাছ কাটার পর আমি ২ মিনিট বিরতি নিয়ে আমার করাতটিকে শান দিয়ে দিই। এটা শোনার পর-ই জনের চোখ খুলে গেল।” ঠিক তেমনি আমরা যখন কোনো কাজ শুরু করি, তখন আমাদের উচিত যথেষ্ট পরিকল্পনা করে কাজটি শুরু করা। এবং কাজটি শুরু করার পর নির্দিষ্ট সময় পর পর বিশ্রাম নিয়ে সেই কাজটির অগ্রগতি কতটুকু সে বিষয়টি তদারকি করা। আর কাজের মাঝে যেকোনো মূহুর্তের মোকাবেলা করার জন্য প্রতিমুহূর্তেই নতুন ভাবে পরিকল্পনা করা। স্টিফেন আর. কোভের “The 7 Habits of Highly Effective People” বই থেকে প্রাপ্ত এই ৭ টি অভ্যাস গঠন করতে পারলে আশা করি আপনি সকলের মাঝে একজন অনন্য মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন। সফল মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া অনেক টা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। শুধু মাত্র অভ্যাস গঠন, অধ্যবসায়ী হওয়া এবং পরিশ্রমী হয়েও সফল হওয়া সম্ভব নয়। এর সাথে ভাগ্য সহায় থাকাটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে বিজ্ঞজনেরা বলেন, যারা পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী, এবং সাহসী, ভাগ্য সাধারণত তাদের প্রতিই সহায় থাকে।
স্টিফেন আর. কোভি এর পূর্ণ নাম স্টিফেন রিচার্ডস কোভি। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন ১৯৩২ সালের ২৪শে অক্টোবর। জন্মগতভাবে তিনি একজন আমেরিকান। তিনি একাধারে একজন শিক্ষক, লেখক, বক্তা ও ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর বক্তব্যগুলো মূলত অনুপ্রেরণাদায়ী, যাকে আমরা বর্তমানে ‘মোটিভেশনাল স্পিচ’ নামেই বেশি চিনি। স্টিফেন আর কোভি এর বই সমূহ হচ্ছে ফার্স্ট থিংস ফার্স্ট, দ্য লিডার ইন মি, দ্য এইটথ হ্যাবিট, প্রিন্সিপ্যাল-সেন্টার্ড লিডারশিপ, দ্য থার্ড অল্টারনেটিভ ইত্যাদি। তাঁর প্রথম বই ছিল স্পিরিচুয়াল রুটস অফ হিউম্যান রিলেশনস (১৯৭০)। এটি ডেসেরেট বুক কোম্পানি থেকে প্রকাশ পায়। তাঁর পরবর্তী লেখাগুলোর পূর্বাভাস হিসেবে এই বইটিকে ধরা যায়। স্টিফেন আর. কোভি এর অনুবাদ বইগুলোর মাধ্যমে তাঁর অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তব্য বিশ্বজোড়া মানুষের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে। বাংলা ভাষাতেও তাঁর বই অনূদিত হয়েছে। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় বই হলো ‘দ্য সেভেন হ্যাবিটস অফ হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’। স্টিফেন আর. কোভি এর বই সমগ্র বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত, কারণ তিনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে মানুষকে অনুপ্রেরণার ছোঁয়া দিতে পেরেছেন। ১৯৯৬ সালের টাইমস ম্যাগাজিন বিশ্বের ২৫ জন সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে তাঁকে রাখে। ২০০৮ সালে তিনি স্টিফেন কোভি অনলাইন সম্প্রদায় গড়ে তোলেন। ২০১২ সালের ১৬ জুলাই কোভি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময়ে তিনি উটাহ স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে জন এম. হান্টসম্যান স্কুল অফ বিজনেসের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর পড়াশোনাও ব্যবসায় অনুষদের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তবে একটা সময় আমেরিকান সেলফ হেল্প বইগুলো পড়ে তাঁর মাথায় চিন্তা আসে যে, এভাবে তিনি অনেককেই হয়তো অনুপ্রাণিত করতে পারবেন। তিনি পিটার ড্রাকার ও কার্ল রজার্সের দ্বারা মনস্তাত্ত্বিকভাবে অনেকটা প্রভাবিত ছিলেন।