"শ্রেষ্ঠ গল্প"বইটির ভূমিকা: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছােটোগল্প সংগ্রহের মধ্যে কতকগুলি প্রথম শ্রেণীর গল্প আছে। প্রেম ও দাম্পত্য-সম্পর্কমূলক গল্পগুলিই প্রধান, কিন্তু পারিবারিক জীবনের অন্যান্য দিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার বিষয়ও উপেক্ষিত হয় নাই। নেকী’, ‘শিপ্রার অপমৃত্যু’ ও ‘সর্পিল' ('অতসী মামী'), ‘মহাকালের জটার জট’, ‘বিষাক্ত প্রেম' (সরীসৃপ'), “শৈলজ শিলা’ ‘খুকী’ (মিহি ও মােটা কাহিনী’)-গল্পগুলিতে প্রেমের বিচিত্র প্রকাশ আলােচিত হইয়াছে। নেকী’ গল্পটি লেখকের প্রথম রচনার অন্যতম- ইহার উপর শরৎচন্দ্রের প্রভাব লক্ষ্য হয়; ইহার গঠন-বিন্যাসও ঠিক নির্দোষ বলা যায় না। শিপ্রার অপমৃত্যু গল্পে পরাশরকে অনিন্দিতার হাত হইতে ছিনাইয়া লইবার জন্য অতিক্রান্তপ্রায়-যৌবনা শিক্ষয়িত্রী শিপ্রার স্পর্ধিত ও দুঃসাহসিক কৌশলজালবিস্তার বর্ণিত হইয়াছে। শেষ পর্যন্ত শিপ্রার ডুবিয়া মরার সম্ভাবনায় পরাশরের নিরুদৃবিগ্ন নিশ্চেষ্টতায় এই অস্বাভাবিকরূপে তীব্র ও বেগবান প্রেমাভিনয়ের আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটিয়াছে। শিপ্রার অশােভন ও নির্লজ্জ আকর্ষণ-প্রয়াসের বর্ণনা খুব উপভােগ্য হইয়াছে। সর্পিল গল্পটি দাম্পত্য-সম্বন্ধের মধ্যে অসুস্থ মনােবিকার ও জ্বর, অকারণ হিংসার ভয়াবহ ছিল। গ্রন্থকারের ‘দিবা-রাত্রির কাব্য'-এর অশােক ও সুপ্রিয়ার অস্বাভাবিক, অপ্রকৃতিস্থ সম্পর্কের মৌলিক বীজটি যেন এই ছােটো গল্পটিতে নিহিত আছে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের হয়ত’ ও ‘শৃঙ্খল’ গল্প দুইটিও এই একই বিকৃতি প্রেরণার অভিব্যক্তি। স্বামী শঙ্করের ধর্মোন্মাদ, তাহার স্ত্রীর আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতি, সংগীতপ্রিয়তা ও বন্ধু-সাহচর্যের বিরুদ্ধে উত্তপ্ত-মস্তিষ্কপ্রসূত বিজাতীয় বিদ্বেষ, কৃত্রিম সারল্য ও সংসারবিরাগের আবরণে পত্নী ও তাহার প্রণয়ীকে চরম শাস্তিপ্রদানের সতর্ক, আট-ঘাট-বাঁধা উদ্যোগ, ভয়াবহ সম্ভাবনার ইঙ্গিত-ব্যঞ্জনাপূর্ণ গৃহাবেষ্টন ও মানবের জ্বর, কুটিল জিঘাংসার সহিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের দৈব-সংঘটিত সহযােগিতা- এই সকলের সমন্বয়ে এক অজ্ঞাতভীতি-শিহরণ-কণ্টকিত প্রতিবেশ রচিত হইয়াছে। এই সংগতিপূর্ণ পটভূমিকাবিন্যাসই প্রেমেন্দ্রের পূর্বোল্লিখিত দুইটি গল্পের সহিত তুলনায় এই গল্পটির শ্রেষ্ঠত্বের কারণ। ‘মহাকালের জটার জট’ গল্পে দুই প্রতিবেশী পরিবারের মধ্যে উদ্ভট, খাপছাড়া, আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব কয়েকটি যৌন আকর্ষণের ইঙ্গিত সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। আমাদের প্রত্যহিক অভিজ্ঞতায় দুই পাশাপাশি বাড়ির লােকেরা একে অপরের প্রতি যে বেশি পক্ষপাত বা টান-আকর্ষণের যে তারতম্য দেখাইয়াছে থাকে, লেখক সেই অকারণ প্রীতি-বৈষম্যের একটি যৌনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিবার চেষ্টা করিয়াছেন। ব্যাপারটির বৈজ্ঞািনিকতা অপেক্ষা ইহার হাস্যকর অসংগতির দিকটাই বেশি ফুটিয়াছে। বিষাক্ত প্রেম’-এ লেখক গণিকাসক্ত যুবকের স্বার্থকলুষিত প্রেমাভিনয়ের মধ্যে এক উচচতর
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।