“নয় এ মধুর খেলা” বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপ এর লেখা : টিনার মনটা হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেল। পুরনাে স্মৃতিরা। সব ভিড় করে এগিয়ে এল । সত্যিই তাে! বুঝতে না বুঝতে বছরগুলাে এমন অনায়াসে গড়িয়ে চলে যায়। রেনের সঙ্গে তার শেষ দেখা হয়েছে দশ বছর আগে । নিউইয়র্কে। অসুস্থ সাব্রিনাকে নিয়ে টিনাই গিয়েছিল নিউইয়র্কে। সাব্রিনার বড় ভাই তখন ওখানকার এক হাসপাতালে ডাক্তার। তারপর সাব্রিনা বার দুয়েক ঢাকা এসেছে। রেনে আর আসেনি। টিনারও এর মধ্যে আর বিদেশে যাওয়া হয়নি। রেনের বিয়ের সময় ওপক্ষ থেকে অনেক অনুনয়, এপক্ষ থেকে অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও টিনার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি এতদূর পাড়ি দিয়ে বিয়ে খেতে যেতে। প্ল্যান-প্রােগ্রাম আবার বদলে গেল । ঢাকা-লন্ডন ফ্লাইট পাল্টে ঢাকা-ফ্রাংকফুর্ট করা হল। তারিখ এগিয়ে আনা হল তিনদিন। কারণ ওয়াশিংটন ডি.সি. পৌঁছােনাের তারিখ পেছানাে যাবে না। পরদিনই টিনাদের প্রােগ্রাম শুরু। টিনার মনটা চলে গেল দশবছর আগের সেই মে মাসের। গ্রীষ্মতপ্ত দিনটিতে, যেদিন সে সম্পূর্ণ অজান্তে পা রেখেছিল এমন একটি ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে, যা পরবর্তীতে তাদের সবারই জীবনের মােড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল ভয়ানক ভাবে ।
শহীদ জননী হিসেবে অধিক পরিচিত জাহানারা ইমাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অনন্য নাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ ও তার বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহবায়ক হিসেবে বাংলাদেশের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের মাঝে তিনি অন্যতম। জাহানারা ইমামের জন্ম অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলায়, ১৯২৯ সালের ৩ মে। রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম হলেও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পিতা আবদুল আলী তাকে পড়ালেখা করান। পরবর্তীতে পুরকৌশলী স্বামী শরীফ ইমামও তাঁর পড়ালেখায় উৎসাহ যোগান। ১৯৪৫ সালে রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৬৫ সালে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেন। চাকরিজীবন শুরু করেন বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্কলার এই কৃতি নারী ষাটের দশকের ঢাকার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মহলে তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্য ছিলেন সুপরিচিত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বড় ছেলে শাফী ইমাম রুমী ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। অসম্ভব মেধাবী রুমী তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে উপেক্ষা করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেছে নিলে তিনি তাকে অনুপ্রেরণা যোগান ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গোপনে সাহায্য করে চলেন যোদ্ধাদের। যুদ্ধে রুমী ধরা পড়লেও তাঁর আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি ও তাঁর স্বামী ক্ষমা চাইতে রাজি হননি ঘাতকদের কাছে। তিনি এই যুদ্ধ চলাকালে রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত দিনলিপি, যা পরবর্তীতে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ নামে প্রকাশিত হয় এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত জাহানারা ইমাম এর বই সমগ্র পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে, এর একটি বড় কারণ হলো তাঁর রচনার হৃদয়গ্রাহীতা ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ। তিনি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ হিসেবে গড়ে তোলেন ‘ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দ, তরুণ প্রজন্মের সক্রিয় সমর্থনে গড়ে তোলেন গণ আদালত। জাহানারা ইমাম এর বই সমূহ হলো ‘অন্য জীবন’, ‘গজকচ্ছপ (শিশুতোষ)’, ‘সাতটি তারার ঝিকিমিকি (শিশুতোষ)’, ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’, ‘প্রবাসের দিনলিপি’ ইত্যাদি। মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন মিশিগানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।