"কালো বরফ" বইয়ের ভূমিকার অংশ থেকে নেয়া: ব্যক্তির হৃদয়কে চিরে চিরে দেখানাের উপযােগী। তার ভাষা, প্রচণ্ড সংক্রমণ শক্তিসম্পন্ন তার প্রকাশভঙ্গি। উত্তরাধিকার শুরু থেকে শেষ অব্দি মাহমুদুল হক তাঁর উপন্যাসকে যেভাবে বুনেছেন, সেই ভাব ও আঙ্গিক খুবই আকর্ষণীয় এবং এর পরিণতিও বেশ পরিণত। তাঁর ভাষায় এমন একটা তরতাজা সৌন্দর্য আছে যা মনকে তৃপ্তি দেয়। আঞ্চলিক শব্দের এমন নিখুঁত ব্যবহার এখানকার খুব কম উপন্যাসেই ইতিপূর্বে লক্ষ্য করা গেছে... একটি উল্লেখযােগ্য উপন্যাস বিনােদন লেখকের কল্পনাশক্তির বিস্তার রীতিমতাে অসাধারণ ... যেখানে খঞ্জনা পাখি এই দশকের। অন্যতম উপন্যাস। পূর্বদেশ ধ্বনির ইন্দ্রজাল সৃষ্টিতে নিপুণ দৈনিক বাংলা এই গ্রন্থের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ভাষার প্রসাদগুণে এবং সাবলীল ও রসময় গতিভঙ্গির জন্য অতি কুৎসিত। কথা ও কুশ্রীতা কেমন সুন্দর কমনীয় ও চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে ... এরূপ ভাষাভঙ্গি আমাদের কথাসাহিত্যে বিরল / চিত্রালী বাংলা গদ্যে প্রভুত্ব করার ক্ষমতা এর আছে। দেশ মাহমুদুল হকের দেখার দৃষ্টি এবং লেখার শক্তি দুই-ই। আছে, সেই সাথে আছে তীক্ষ্ণ নিপুণ প্রকাশক্ষম ভাষা। তিনি সহজ ভাষার কথক নন, অন্তর্গত জটিলতার উন্মােচনই তার অভীষ্ট।
মাহমুদুল হক ১৯৪০ সালে পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে জন্ম গ্রহণ। তার পিতার নাম সিরাজুল ইসলাম, মায়ের নাম মাহমুদা বেগম। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের সময় পর পিতা সরসারের উচ্চপদে চাকরিসূত্রে পূর্ব পাকিস্তানে যোগদান করেন এবং বেশ পরে তিনি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে ১৯৫১ সালে আজিমপুরে বসবাস শুরু করেন। তিনি ছয় ভাই চার বোনের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন। মাহমুদুল হকের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়েছিল বারাসাতের কালীকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু দেশ ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে ১৯৫২ সালে লালবাগের ওয়েস্ট এন্ড স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। রাতকানা রোগের কারণে মাঝখানে কিছুদিন তিনি পড়ালেখায় বিরতি দেন। পরে তিনি ১৯৫৮ সালে মেট্রেকুলেশন পাস করেন। পরে তিনি জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হলেও পড়ালেখার চেয়ে আড্ডাবাজিতে মগ্ন হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার ইতি ঘটান। দৈনিক সংবাদ পত্রিকার অনুবাদক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু তিন মাসের মাথায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি প্রথমে মনোহারি পরে জুয়েলারি ব্যবসার সাথে যুক্ত হন। পরে অবশ্য মীজানুর রহমান এবং প্রতাপউদ্দিনের সাথে মিলি ‘গাঙচিল প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৬৭ সালে; কিন্তু এ ব্যবসাও তার টেকে নি। মাহমুদুল হকের শিক্ষক ছিলেন কথাশিল্পী শহীদ সাবের। তাঁর প্রত্যক্ষ প্রেরণায় তিনি সাহিত্যের সাথে যুক্ত হন এবং প্রথমে ‘অগ্রগামী’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির মাত্র ৩টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। মাহমুদুল হক যখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র তখন ‘রেড হর্নেট’ (১৯৫৪) ডিটেকটিভ উপন্যাস রচনা করেন। এ সময় তিনি ‘অরণ্য বাসর’ ও ‘আমি সম্রাট’ নামি দুটি রোমাঞ্চধর্মী উপন্যাসও লিখেছিলেন। তবে তিনি ১৯৮৪ সালের পর আর লেখালেখি করেন নি।