"খেলাঘর" বইটির শেষের ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ কেন ডাকনাম থাকতে নেই নাকি? দাদাভাই ডাকতাে ঝুমি, দিদামণি ডাকতাে আন্না, মামা ডাকতাে গাব্বু, স্কুলের মেয়েরা ডাকতাে টেপি। সই পাতিয়েছিলাম একজনের সঙ্গে, সে নাম দিয়েছিল লতা। আমি তার নাম দিয়েছিলাম পাতা। দু’জনকে একসঙ্গে দেখলে কেউ কেউ ছড়া কেটে বলতাে, লতাপাতা যায়, ফিরে ফিরে চায়। পাতাটা ছিল ভারি মুখফোড়, ও বলতাে, লতাপাতা যায়, গরু পিছে ধায়। আচ্ছা তুমি কখনাে কড়িগাট্টা খেয়েছ? কি ভালােই না লাগতাে। আমাদের ক্লাসের একটা ছেলের নাম ছিল বাবু। বাবুদের বাড়িতে ছিল ফলশা গাছ। আমি আর পাতা বাবুর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলাম, যা ভালােবাসতাম ফলশা! বাবুটার কি হয়েছিল জানাে? লরির তলায় চাপা পড়ে মরে গিয়েছিল বাবু। চাপা পড়বে না, গাধাটা এমন আপনভােলা ছিল! এই দ্যাখাে পাতার কথাই বলা হয়নি, পাতা মরে গিয়েছিল পুকুরে ডুবে। ঝুমি ওরফে আন্না ওরফে গাব্বু ওরফে টেপি ওরফে লতা। সেই মেয়েটির গল্প শুনিয়েছেন আমাদের কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী মাহমুদুল হক। উচ্চশিক্ষিতা কুমারী অপাপবিদ্ধার স্বপ্নের খেলাঘর কীভাবে যে ভেঙে যায়! ১৯৭১-এর গ্লানি আর যন্ত্রণায় মাখামাখি গৌরব সে কি জেনেছিল?
মাহমুদুল হক ১৯৪০ সালে পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে জন্ম গ্রহণ। তার পিতার নাম সিরাজুল ইসলাম, মায়ের নাম মাহমুদা বেগম। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের সময় পর পিতা সরসারের উচ্চপদে চাকরিসূত্রে পূর্ব পাকিস্তানে যোগদান করেন এবং বেশ পরে তিনি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে ১৯৫১ সালে আজিমপুরে বসবাস শুরু করেন। তিনি ছয় ভাই চার বোনের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন। মাহমুদুল হকের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়েছিল বারাসাতের কালীকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু দেশ ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে ১৯৫২ সালে লালবাগের ওয়েস্ট এন্ড স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। রাতকানা রোগের কারণে মাঝখানে কিছুদিন তিনি পড়ালেখায় বিরতি দেন। পরে তিনি ১৯৫৮ সালে মেট্রেকুলেশন পাস করেন। পরে তিনি জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হলেও পড়ালেখার চেয়ে আড্ডাবাজিতে মগ্ন হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার ইতি ঘটান। দৈনিক সংবাদ পত্রিকার অনুবাদক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু তিন মাসের মাথায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি প্রথমে মনোহারি পরে জুয়েলারি ব্যবসার সাথে যুক্ত হন। পরে অবশ্য মীজানুর রহমান এবং প্রতাপউদ্দিনের সাথে মিলি ‘গাঙচিল প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৬৭ সালে; কিন্তু এ ব্যবসাও তার টেকে নি। মাহমুদুল হকের শিক্ষক ছিলেন কথাশিল্পী শহীদ সাবের। তাঁর প্রত্যক্ষ প্রেরণায় তিনি সাহিত্যের সাথে যুক্ত হন এবং প্রথমে ‘অগ্রগামী’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির মাত্র ৩টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। মাহমুদুল হক যখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র তখন ‘রেড হর্নেট’ (১৯৫৪) ডিটেকটিভ উপন্যাস রচনা করেন। এ সময় তিনি ‘অরণ্য বাসর’ ও ‘আমি সম্রাট’ নামি দুটি রোমাঞ্চধর্মী উপন্যাসও লিখেছিলেন। তবে তিনি ১৯৮৪ সালের পর আর লেখালেখি করেন নি।