সুদূর সমুদ্রপাড়ে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ। মালয়, সুমাত্রা আর বোর্নিওর শ্বাপদ-সংকুল নিরক্ষীয় বৃষ্টি বন। সেখানে ছিল এক ভারতীয় উপনিবেশ। চম্পারাজ্য। ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই রাজ্যে নাকি এখনও লুকিয়ে আছে বিপুল রত্নভান্ডার আর রয়েছে হিন্দু সভ্যতার নানা নিদর্শন। ‘চাঁদের পাহাড়’-এর পর বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় বাঙালি কিশোর পাঠকদের মনে রোমাঞ্চ আর অভিযাত্রার রং ছড়াতে লিখেছিলেন শ্বাসরুদ্ধ করা অসাধারণ এই অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি। যার নায়ক সুশীল। সঙ্গে তার খুড়তুতো ভাই সনৎ। তাদের রক্তে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা! আছে জামাতুল্লা। যার কথায় সুশীল আর সনৎ বেরিয়ে পড়ল। ঘর ছেড়ে। গভীর বনে লুকিয়ে থাকা গুপ্তধনের চেয়েও অজানাকে জানার আগ্রহে। চিনা জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি, দুর্ধর্ষ জলদস্যু, গুপ্তঘাতক, অজানা দ্বীপ, প্রাচীন দুর্গ, বাঘ-অজগর-কুমিরের ভয়, গুপ্তধন কী নেই বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ১৯৪৬ সালে প্রথম প্রকাশিত রোমাঞ্চকর কিশোর উপন্যাস ‘হীরামানিক জ্বলে’তে? টান টান এ উপন্যাস পড়তে পড়তে গায়ের রোম যে খাড়া হয়ে যাবেই তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। “পৃথিবীর কত পর্বতে, কন্দরে, মরুতে, অরণ্যে অজানা স্বর্ণরাশি মানুষের চোখের আড়ালে আত্মগোপন করে আছে- বেরিয়ে পড়তে হবে সেই লুকোনো রত্নভান্ডারের সন্ধানে- যদি পুরুষ হও! নয়তো আপিসের দোরে দোরে মেরুদণ্ডহীন প্রাণীদের মতো ঘুরে ঘুরে সেলাম বাজিয়ে চাকুরির সন্ধান করে বেড়ানোই যার একমাত্র লক্ষ্য, তার ভাগ্যে নৈব চঃ নৈব চ!” -এই বিজয় অভিযানের কাহিনিই- ‘হীরামাণিক জ্বলে’।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।