ভূমিকা ‘পাতালপুরী’ কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হকের শেষতম রচনা। ১৯৮১ সালে সাপ্তাহিক রোববার সাময়িকীর ঈদ সংখ্যায় পত্রস্থ হয়েছিলা এই উপন্যাস, কিন্তু এরপর আর গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয়ে উঠে নি। সেই সময় থেকে মাহমুদুল হক গ্রন্থপ্রকাশে আগ্রহ ও উদ্যম ক্রমে হারিয়ে ফেলতে থাকেন। তখন ইতিপূর্বে প্রকাশিত একটি দুটি পাণ্ডুলিপি হিসেবে আমাদের দিক থেকেও জোর তাগিদ দেয়া যায় নি, কারণ সাময়িক পত্রের ঈদসংখ্যায় প্রথম প্রকাশকালে, পত্র-পত্রিকার ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, শেষ মুহূর্তে প্রাপ্ত বিজ্ঞাপনের চাপে উপন্যাসের অবস্থান হয়ে পড়ে কুণ্ঠিত এবং কাটছাঁট করে প্রকাশিত হয় ‘পাতালপুরী’ । সেই সাথে খোয়া যায় মূল রচনা, যার হদিশ করতেও বিশেষ তৎপর ছিলেন না মাহমুদুল হক। আমাদের পীড়াপীড়িতে অনেক পরে তিনি কিছুটা নিমরাজি হয়েছিলেন ‘পাতালপুরী’র পরিমার্জিত পরিবর্ধিত ভাষ্য প্রকাশে। কিন্তু সেই কাজটি কখনোই করা হয়ে উঠলো না। দুয়েকবার চেষ্টা যে তিনি নেন নি, তা নয়; তবে যখন জানালেন অনেককাল আগে ব্যবহৃতদ সেই ভাষার খেই আর খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি, ঘটনার ভেতরে প্রবেশ করতে পারঙ্গম হচ্ছেন না, তখন আমরাও বুঝতে পারি ছিন্নমালা আর গাঁথা হয়ে উঠবে না। তাই দীর্ঘকাল ‘পাতালপুরী’ অপ্রকাশিত ভাবেই পড়ে রইলো। মাহমুদুল হকের প্রয়াণের পর, তাঁর স্মৃতির প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে ,অনিচ্ছুক এই প্রকাশনার কাজে আমরা অগ্রসর হলাম তাঁর লেখালেখির পূর্ণরূপ মেলে ধরবার তাগিদ থেকে। আমরা সচেতন রয়েছি বর্তমান গ্রন্থরূপ অপূণাঙ্গ এবং লেখকের ইচ্চামূলক নয়, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও ভাবজগতের পরিচয় জানতে এই কর্তিত রূপটির কোনো বিকল্প নেই । আর তাই ‘পাতালপুরী’র গ্রন্থরূপ আমরা পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছি সভয়ে, অনেক বেদনা ও অপূর্ণতার দু:খভার নিয়ে। আশাকরি সহৃদয় পাঠকের যথাযথ বিবেচনা লাভ করবে এই গ্রন্থ। মফিদুল হক ঢাকা, ফেব্রুয়ারি,২০০৯
মাহমুদুল হক ১৯৪০ সালে পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে জন্ম গ্রহণ। তার পিতার নাম সিরাজুল ইসলাম, মায়ের নাম মাহমুদা বেগম। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের সময় পর পিতা সরসারের উচ্চপদে চাকরিসূত্রে পূর্ব পাকিস্তানে যোগদান করেন এবং বেশ পরে তিনি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে ১৯৫১ সালে আজিমপুরে বসবাস শুরু করেন। তিনি ছয় ভাই চার বোনের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন। মাহমুদুল হকের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়েছিল বারাসাতের কালীকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু দেশ ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে ১৯৫২ সালে লালবাগের ওয়েস্ট এন্ড স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। রাতকানা রোগের কারণে মাঝখানে কিছুদিন তিনি পড়ালেখায় বিরতি দেন। পরে তিনি ১৯৫৮ সালে মেট্রেকুলেশন পাস করেন। পরে তিনি জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হলেও পড়ালেখার চেয়ে আড্ডাবাজিতে মগ্ন হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার ইতি ঘটান। দৈনিক সংবাদ পত্রিকার অনুবাদক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু তিন মাসের মাথায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি প্রথমে মনোহারি পরে জুয়েলারি ব্যবসার সাথে যুক্ত হন। পরে অবশ্য মীজানুর রহমান এবং প্রতাপউদ্দিনের সাথে মিলি ‘গাঙচিল প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৬৭ সালে; কিন্তু এ ব্যবসাও তার টেকে নি। মাহমুদুল হকের শিক্ষক ছিলেন কথাশিল্পী শহীদ সাবের। তাঁর প্রত্যক্ষ প্রেরণায় তিনি সাহিত্যের সাথে যুক্ত হন এবং প্রথমে ‘অগ্রগামী’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির মাত্র ৩টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। মাহমুদুল হক যখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র তখন ‘রেড হর্নেট’ (১৯৫৪) ডিটেকটিভ উপন্যাস রচনা করেন। এ সময় তিনি ‘অরণ্য বাসর’ ও ‘আমি সম্রাট’ নামি দুটি রোমাঞ্চধর্মী উপন্যাসও লিখেছিলেন। তবে তিনি ১৯৮৪ সালের পর আর লেখালেখি করেন নি।