ভূমিকা মাথার ওপর থেকে ছায়া যখন সরে গেল, তখনই প্রথম অনুভব করলাম যে, প্রায় দশ বছর দাঁড়িয়েছিলাম এক মহামহীরূহের ছায়ায়, যে আর নেই! সময়টা ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর, এবং সেই মহীরূহের নাম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার মাতামহ। আর উমাশশী দেবী আমার দিদিমা। তাঁদের পাঁচ সন্তান, সনৎকুমার, সরিৎকুমার, গঙ্গা, বুলি ও বাণী । গঙ্গাদেবী আমার মা। বুলি মাসীকে আমি দেখিনি, কারণ আমার জন্মের বহু আগেই তিনি গত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর শোক আমার দাদু যে ভুলতে পারেননি, তা দেখেছি! প্রকৃতপক্ষে, সংসারের ছবিটা যে অমনি অজস্র অদৃশ্য শোকের সুতোয় বোণা একটা জালের মতো, তাতো প্রথমেই বোঝা যায় না। শৈশবের অনুভব ওই অদৃশ্য সুতোর অস্তিত্ব ধরাই পড়ে না। আমার কাছেও অধরাই ছিল। তারপর যত বড় হয়েছি ততোই তার আভাস পেয়েছি। এরকম কত যে বেদনা আমাদের পিতৃকূলেও প্রচ্ছন্ন হয়েছিল, তাও শুনেছিলাম মায়েরই মুখে। আমার নাকিএক বড় পিসি ছিলেন। তিনি ভুলি পিসি, আমার বাবার চেয়েও বয়সে বড়। শুনেছি তিনি ছিলেন অপরূপ সুন্দরী, কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। কারণটা অবশ্য পরে জেনেছিলাম, কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। আপাতত বলি, কন্যাবিয়োগের সে ব্যথা আমার ঠাকুর্দাও বহন করেছিলেন সারাজীবন। এমন অজস্র শোকের কথা জানতাম যা আমাদের সংসারকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে রেখেছিল। তার সামান্যই আমি নিজের চোখে দেখেছি, বেশর ভাগটাই শোন। শোনা আমার মায়ের মুখে। কত শোক, কত দু-খ, কত রহস্য, কত ভৌতিকতা, কত আধিদৈবিকতার কথা মা একবার বলতে শুরু করলেই, যেন কী এক মায়ামন্ত্র বলে তা ধীরে ধীরে গল্পের মতো সমগ্র পরিমণ্ডলকেই আচ্ছন্ন ক'রে তুলতো। এ দৃশ্য কতবার যে দেখেছ তার হিসেব নেই । মা একবার বলতে শুরু করলে, ‘আমাদের সে আমলে, লাভপুর তখন এক গণ্ডগ্রাম...’