মাঝির ছেলে মানিকের একমাত্র সম্পূর্ণ কিশাের-উপন্যাস। এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নাগার জীবনসূত্রেই মানিক উন্মােচন করেছেন আমাদের সমাজসত্যের কিছু নির্মম দিক। উপন্যাসে নাগার বয়স সতেরাে-আঠারাে বছর, পিতৃমাতৃহীন সে। শুধু তাই নয়, একেবারেই অনাত্মীয় পরিবেশে অতিবাহিত হয় তার জীবন। একমাত্র নিকটজন পিতৃব্য ও তার পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্কও আত্মীয়তার নয়, বরং মালিক-কর্মচারীর। দারিদ্র্যের নির্মম বাস্তবতায়। সে লালিত-পালিত ও বর্ধিত। ফলে ক্ষুধাতাড়না তার অন্যতম জীবনবৈশিষ্ট্য। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নাগার মনােজগৎকে আচ্ছন্ন করে আছে নদীজলের মাদকতা। নদীর পরিচ্ছন্ন সুশীতল মুক্ত বায়ুর পরশ তার জীবনভাবনায়ও সঞ্চার করে সংস্কারমুক্ত ঔদার্য। নদীপৃষ্ঠে বসবাসের মধ্যেই সে অনুভব করে জীবনের সার্থকতা ও সুখ।। শুধু নদী নয়, নাগার মনে সমুদ্রের প্রতিও রয়েছে তীব্র আকর্ষণ। একবার সমুদ্রে গিয়ে একটুখানি স্বাদ পেয়েই সমুদ্রের প্রতি তার টান হয়ে উঠেছে দুরন্ত। তখন রূপাকে বিয়ের কথা বলেও সমুদ্রের কথা ভেবে সে দ্বিধান্বিত হয়। তার মনে হয় : রক্তমাংসের একটা মেয়ের জন্য কি সমুদ্রকে হেঁটে ফেলা যায় জীবন থেকে। সে সমুদ্রের এক প্রান্তের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত পাড়ি দিলে রােমাঞ্চকর উল্লাসের সঙ্গে মনে হয় এই সমুদ্রই হাজার হাজার মাইল দূরে অজানা অচেনা রহস্যময় দেশের প্রান্ত স্পর্শ করে আছে। শুধু মাঝির ছেলে নাগার মনেই যে নদী বা সমুদ্রপ্রীতি তীব্র তা নয়, তালুকদার-জমিদার যাদববাবুর কাছেও নদী এক তীব্র রােমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। দিনরাত শুধু জলে ভেসে কাটিয়ে দিতেই স্বাদ জাগে তার মনে। এ কারণেই তার নিশ্চিত ধারণা : ‘মাঝিগাে মতন সুখী মানুষ জগতে নাই। কিশাের-উপন্যাস হিসেবে মাঝির ছেলের সার্থকতার সূত্রটি নাগার সমুদ্রস্বপ্নের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। সমুদ্রকে অবলম্বন করে নাগার মধ্যে যে কৈশােরক স্বপ্ন বর্ধিত হয়েছে তা অসীমের প্রতি মানবাত্মার এক চির আকর্ষণের সঙ্গে যুক্ত। —সৈয়দ আজিজুল হক
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।