পাবলিশার’স নোট মাইকেল মধুসূদন দত্তরে (১৮২৪ - ১৮৭৩) বলা যাইতে পারে পয়লা সাকসেসফুল পোয়েট, কলোনিয়াল বাংলা-ভাষার। নাটক, প্রহসন লেখলেও উনার “মেঘনাথবধ কাব্য” এবং “চতুর্দ্দশপদী কবিতা” হইতেছে সবচে সিগনিফিকেন্ট ঘটনা। উনার আগে বাংলা-ভাষায় যারা কবিতা লেখছেন - ভারতচন্দ্র রায় (১৭১২), এমনকি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তও (১৮১২) কবিতাতে ইউরোপিয়ান, কলোনিয়াল চিন্তা ও ফর্মরে সেন্টার করতে পারেন (চাইছিলেনও কি!) নাই। সেইখানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত-ই ফার্স্ট এক্সাম্পল। এইটা বাদে বা এইটাসহ মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার আরো এটলিস্ট দুইটা সিগনিফেকন্স আছে। এক, উনি ‘আধুনিক’ বা কলোনিয়াল-বাংলাতে লেখছেন। যেইটা ধরেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রেস্কাইবড বাংলা, সংস্কৃত-বহুল, কইতে গেলে ঝঙ্কার উঠে, জিব্বায় টং কইরা উঠে, এইরকম।… মানে, মাইকেল মধুসূদন দত্তের আগে (এবং এমনকি পরেও) এই ঝঙ্কার খুববেশি পাইবেন না। এইটা উনার ভাষার একটা ইউনিক ফিচার। উনার কবিতা আধুনিক-কলোনিয়াল বাংলা-ভাষার একটা মেনিফেস্টেশন। যেই কারণে “অতি আদরের জিনিস” এবং এখনো কলেজ-ভারসিটিগুলার বাংলা-ডিপার্টমেন্টে উনার কবিতা পড়ানো হয়। ভাষা হিসাবে “আধুনিক” - এইটা মেজর একটা ক্লেইম উনার কবিতার। সেকেন্ড হইতেছে, কবিতার ফর্ম। মধুসূদনের আগ পর্যন্ত বাংলা-কবিতা ছিল “গীতি-কবিতা” এবং এর পরেও তিরিশের দশকে আইসা ইউরোপিয়ান মডেলটা আইডিওলজিক্যালি বাংলা-কবিতার দখল নেয়ার আগ পর্যন্ত কবিদের গান লেখতে হইতো, গান বা গীতি-কবিতা না লেইখা কারো পক্ষে কবি হওয়াটা বেশ টাফ ছিল, মানে, তেমন কোন নজির মনে হয় নাই।… গান আর কবিতা - দুইটা আলাদা ঘটনা হইতে পারে নাই অইভাবে, বাংলা-ভাষায়। (কিছু ফারাক তো ছিলই, কিন্তু সেইটা জরুরি ছিল না।) কিন্তু মধুসূদনের কবিতা তো গান না-ই, বরং এর থিকা অনেক দূরের একটা ঘটনা। সুর কইরা তো অবশ্যই পড়া যায়, কিন্তু সেইটা হইতেছে “কবিতার ছন্দ”। সনেটের চাইতেও উনার বড় আবিষ্কার হইতেছে “অমিত্রাক্ষর ছন্দ”; করি, পড়ি, মরি… এইরকম মিল-দেয়াটা যেইখানে জরুরি না।… কিন্তু উনার এই ছন্দ “অলংকার” হিসাবেই রয়া গেছে, অনেক বেশি ফলো করা হইছে - এর উদাহারণ কমই। তো, খালি ছন্দই না, কবি হিসাবে উনার লিগাসিও পরের বাংলা-কবিতাতে কমই। মানে, খেয়াল করলে দেখা যাবে, মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা এক ধরণের “বিচ্যুতি”, বাংলা-কবিতার হিস্ট্রিক্যাল কনটেক্সটে। কিন্তু অই একসেপশনের কারণেই সেলিব্রেটেড - এইটা ভাবাটা কিছুটা ভুলই হবে। যদিও এইটাই ন্যারেটিভ হিসাবে চালু আছে। কিন্তু সোশিও-পলিটিক্যাল জায়গাগুলারে বাদ দিয়া পড়ার কারণে এইটা অনেক বেশি অবভিয়াস মনে হইতে থাকে আসলে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত অবশ্যই ‘বিদ্রোহী’ হইছেন, ট্রেডিশনাল বাংলা-কবিতার কনটেক্সটে, কিন্তু সেইটা হইছেন উনি ‘ইউরোপিয়ান’ ট্রেডিশনরে মান্য করার ভিতর দিয়া। কলকাতার বামুনদের দিয়া ‘ত্যাজ্য’ হওয়ার পরে এর চে বড় বামুনের পৈতা উনি পড়ছেন। এবং একসেপ্টেড হইছেন। এইটা খালি উনার কবি-জীবনের ঘটনাই না, কবিতার ব্যাপারেও ইরিলিভেন্ট না এতোটা। এট লিস্ট দেড়শ বছর পরে আইসা এইটা কিছুটা খেয়াল করতে পারা যাইতে পারে মনে হয়।…
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২৫ জানুয়ারি, ১৮২৪ – ২৯ জুন, ১৮৭৩) ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও নাট্যকার। তাঁকে বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণ্য করা হয়। ব্রিটিশ ভারতের যশোর জেলার এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশে জন্ম হলেও মধুসূদন যৌবনে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে মাইকেল মধুসূদন নাম গ্রহণ করেন এবং পাশ্চাত্য সাহিত্যের দুর্নিবার আকর্ষণবশত ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। জীবনের দ্বিতীয় পর্বে মধুসূদন আকৃষ্ট হন নিজের মাতৃভাষার প্রতি। এই সময়েই তিনি বাংলায় নাটক, প্রহসন ও কাব্যরচনা করতে শুরু করেন। মাইকেল মধুসূদন বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মেঘনাদবধ কাব্য নামক মহাকাব্য। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি হলো দ্য ক্যাপটিভ লেডি, শর্মিষ্ঠা, কৃষ্ণকুমারী (নাটক), পদ্মাবতী (নাটক), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, একেই কি বলে সভ্যতা, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, চতুর্দশপদী কবিতাবলী, হেকটর বধ ইত্যাদি। মাইকেলের ব্যক্তিগত জীবন ছিল নাটকীয় এবং বেদনাঘন। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যু হয় এই মহাকবির।