অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বাঙালি কিশোরদের জন্য বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যখন মরণের ডঙ্কা বাজে উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেন তখন বিশ্বজুড়ে চলছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব। ইতালিতে মুসোলিনি, জার্মানিতে হিটলারের অভ্যুদয় ঘটেছে। আবিসিনিয়ায় চলছে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ আর স্পেনে সিভিল ওয়ার। যুদ্ধের আঁচ তখনও লাগেনি বাংলায়, যদিও বুদ্ধিজীবী সমাজের চিত্তে প্রবল বেগে নাড়া দিয়েছে এ অস্থিরতা। চীন-জাপানের ভয়ংকর যুদ্ধে দুজন বাঙালি যুবক বিমল ও সুরেশ্বরের ভাগ্যচক্রে জড়িত হয়ে পড়াই ছিল এর উপজীব্য। তাদের পরিচয় হয় রেঙ্গুনের পথে এক স্টিমারে। দুজনেরই গন্তব্য সিঙ্গাপুর। লক্ষ্য নতুন পেশাজীবন আর¤ ¢ করা। কিন্তু সিঙ্গাপুর থেকেই তারা জড়িয়ে পড়ল চীন-জাপান যুদ্ধে। কনসেশন আর্মির হয়ে কাজ করতে লুকিয়ে হাজির হলো সাংহাই। তারপরে জাপানি বোমারু বিমান আর যুদ্ধের দামামা। সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে বিভূতিভূষণই সর্বপ্রথম সমকালীন যুদ্ধের কাহিনি নিয়ে উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তাই উপন্যাসটি বিভূতি-সাহিত্যে এবং একইসঙ্গে বাংলাসাহিত্যেও অভিনব। সুধীরচন্দ্র সরকার সম্পাদিত ছোটদের বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা মৌচাক-এ ধারাবাহিক রচনা হিসেবে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় মরণের ডঙ্কা বাজে। পুস্তকাকারে প্রথম আবির্ভাব ১৫ জানুয়ারি ১৯৪০। ১৬ পৃষ্ঠার ডবল ক্রাউন সাইজে। প্রকাশক ছিল মেসার্স বি. এন. পাবলিশিং হাউস, কলিকাতা।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।