কোনো দিনও ভারতবর্ষের বাইরে পা রাখেননি- এমন একজন মানুষ লিখেছিলেন চাঁদের পাহাড় উপন্যাসটি, আফ্রিকার পটভূমিতে। শিশু-কিশোরদের পত্রিকা মৌচাক-এর জন্য। ১৯৩৭ সালে প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় লেখক ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘চাঁদের পাহাড় কোনো ইংরেজি উপন্যাসের অনুবাদ নয় কিংবা ওই শ্রেণির কোনো বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনেও লেখা হয়নি। এই বইয়ের গল্প ও চরিত্র আমার কল্পনাপ্রসূত।’ বাংলার ছেলের আফ্রিকা মহাদেশ জয়ের দুঃসাহসিক বর্ণনার ভৌগোলিক সংস্থানে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় হ্যারি জনস্টন, রোসিটা ফর্বস-এর মতো বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চারারদের দারস্থ হয়েছিলেন। শঙ্কর রায় চৌধুরী। সময়কাল ১৯০৯। সবে এফ.এ. পাস দিয়েছে। ভূগোলপ্রেমী শঙ্কর ফুটবল দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড। তেমনি সাঁতার আর বক্সিংয়েও চ্যাম্পিয়ন। শ্যামনগর কি নৈহাটীর পাটকলের চাকরির বদলে সে চায় উড়ে যেতে, পৃথিবীর দূর দূর দেশে। শত দুঃসাহসিক কাজের মাঝখানে। লিভিংস্টোন, স্ট্যানলি, জনস্টনের মতো। সুযোগটাও পায়। সুদূর আফ্রিকার উগান্ডা রেলওয়েতে চাকরি হয়। পরিচয় ঘটে পর্তুগিজ স্বর্ণসন্ধানী ডিয়েগো আলভারেজের সাথে। হীরার খনির সন্ধানে শুরু হয় এক রোমাঞ্চকর অভিযান। পথে পথে মৃত্যুর হাতছানি। বুনিপ আর ডিঙ্গোনেকের ভয়। চাঁদের পাহাড় বিভূতিভূষণ একটি বিশেষ কথা লিখেছেন, ‘মানুষের আয়ু মানুষের জীবনের ভুল মাপকাঠি।’ শঙ্কর দেড় বছরে আফ্রিকায় যে জীবন উপভোগ করেছে সেজন্য স্বপ্ন থাকতে হয়, অনেকটা ত্যাগ থাকতে হয়। চাঁদের পাহাড় আজও শিশু-কিশোর পাঠকদের সাহস দেয় অভিযাত্রিক হওয়ার।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।