আরবীর নিজস্ব ভাষা ও লিপি রয়েছে। মূলত এটি আরব গোত্র সমূহের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রচলিত ভাষা হিসেবে বিদ্যমান থেকেছে। বিশেষভাবে লাখমী ও গাস্সানীদের মত গোত্রে, যারা তাদের মুখে মুখে কবিতা রচনায় বিশ্বখ্যাতি কুড়িয়েছে, এ গোত্র দক্ষিণ ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বসবাস করত। এদের শাসন করত বাইজেন্টাইন শাসকগণ, পরে সাসানীয় সুলতানগণ, যারা ইরাক এবং ইরানকে শাসন করেছে। ৬২২ খৃ. ইসলামী রাষ্ট্রের পত্তন হওয়ায় এ সমস্ত অঞ্চল মুসলমানদের অধিকারে আসে। আরবী মূলত হিব্রু, গ্রীক ও ল্যাটিনের সমগোত্রীয় লিপি, যা খৃষ্টপূর্ব ২০০০ বছর পূর্ব থেকে ফিনিসিয়ান লিপিমালা থেকে ক্রমাগত উন্নয়ন লাভ করতে থাকে। আরবী হরফের আকৃতির উৎস কী? এ সম্পর্কে অনেক পাণ্ডিত্যপূর্ণ মতামত রয়েছে, তবে সবচেয়ে আলোচিত ও গ্রহণযোগ্য মতটি হচ্ছে, এটি অ্যারোমিক লিপি যাকে নাবাতিয়ানরা সংস্কার করে নিজেদের মত করে ব্যবহার করত। নাবাতিয়ানদের বসবাস ছিল ঐশ্বর্যশালী রাজধানী পেত্রা কেন্দ্রীক, যা' আজও ধ্বংসাবশেষরূপে জর্ডানে টিকে রয়েছে। আমরা জানি, আরবী ভাষা হচ্ছে কুরআনের ভাষা- পবিত্র গ্রন্থ, যেটা সপ্তম শতাব্দিতে মহান ফিরিশতা জিব্রাইলের মাধ্যমে রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর ওপর হেরা গুহা থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৩ বছর যাবত ক্রমান্বয়ে নাযিল হয়। এর সাথে সাথে এই পবিত্র বাণীকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় আরবী হরফে লিপিবদ্ধ করা হয়। সুতরাং কুরআনের ভাষা ও হরফ হওয়ায় আরবী মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ পবিত্রতার সম্মানে অধিষ্ঠিত হয়েছে। এজন্য যখনি কুরআনের কপি অনুলিপি করা হয়, তখনি একে যতটা সম্ভব সুন্দর মনমুগ্ধকর করে লিপিবদ্ধ করা হয়। সেই প্রাথমিক সময়ে ধর্মীয় বাণী লিপিবদ্ধ করার জন্য এবং স্থাপত্যে ব্যবহারের জন্যে উৎকীর্ণ লিপি হিসেবে কৌণিক ধারার লিপি ব্যবহার করা হত। সাধারণভাবে যাকে আমরা কুফি লিপি হিসেবে জানি। কিন্তু প্রত্যহ ব্যবহারিক কাজে বিশেষ করে প্যাপিরাস কাগজের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হয় গোলায়িত ধারার লিপি। ১২শ শতাব্দির পরে কৌণিক লিপি অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠে, ফুল- লতা-পাতার অলংকরণে এটি পরিপূর্ণ স্থূলধারার লিপিতে পরিণত হয়। যে জন্য কুরআন কপিতে এর ব্যবহার বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এদিকে এই শূন্যস্থান পূরণ করতে সহজে পাঠযোগ্য প্রাঞ্জল প্রবহমান লিপি হিসেবে গোলায়িত ধারার লিপিগুলোর ব্যবহার শুরু হয়। বিশেষ করে নাসখী লিপি সুদূর পশ্চিম আফ্রিকার মরক্কো থেকে স্পেন এবং দূর প্রাচ্যে মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ইসলামের বিস্তারের সাথে সাথে আরবী হরফও প্রভাব বিস্তার লাভ করে। পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত ও বুঝে পড়ার জন্য স্থানীয় ভাষার সাথে আরবীও বিশুদ্ধ ভাবে শিখতে হয়। এতে করে কোন কোন স্থানীয় ভাষায় আরবী হরফ প্রতিস্থাপিতও হয়; যেমন-ফার্সী, উর্দু, পশতু, দারী, মালে, ওসমানীয় তুর্কী (১৯২৮ সালে কামাল আতাতুর্ক কর্তৃক রোমান তুর্কী হরফ প্রতিস্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত)। এমনকি বর্তমান সময়েও ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়ার কিছু কিছু ভাষায় রোমান হরফের বদলে আরবী হরফের ব্যবহার শুরু হয়েছে। সুতরাং আরবী হরফ বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে বহুল ব্যবহৃত একটি লিপি। আরবী লিপি হচ্ছে প্রবহমান ঝরণাধারার মত প্রাণোচ্ছল ও সদা বিকাশমান মনমুগ্ধকর হরফমালা। বিখ্যাত ফার্সী ক্যালিগ্রাফার মীর আলী, হেরাত (মৃ. ১৫৫৬ খৃ.) ক্যালিগ্রাফির শিক্ষানবিসদের জন্য একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন, পরামর্শটি হলো: "একজন ক্যালিগ্রাফারের জন্য পাঁচটি বিষয় স্মরণ রাখা কর্তব্য- এক. সূদূর প্রসারী মানসিকতা। দুই. ক্যালিগ্রাফির সূক্ষ্ম কারুকাজ ও কলাকৌশল বুঝার ক্ষমতা। তিন. একটি চমৎকার নমনীয় হাত। চার. প্রচণ্ড ধৈর্য ও কষ্টসহিষ্ণু সামর্থ্য এবং পাঁচ. সঠিকভাবে ক্যালিগ্রাফি করার জন্য যথাযথ যন্ত্রপাতি ও উপকরণ।"