আরণ্যক বিভূতিভূষণের অন্যতম উল্লেখযোগ্য রচনা। মূল বাংলা ছাড়াও আরণ্যক সাহিত্য আকাদেমির প্রচেষ্টায় ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত করা হয়েছে। যেমন— ওড়িয়া, তেলুগু, গুজরাটি, মারাঠী, মালয়ালম, পাঞ্জাবী এবং হিন্দি। উপন্যাসের নায়ক হলেন সত্যচরণ একজন তরুণ যুবক, যাকে কাজের সন্ধানে কলকাতার বহু জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। একসময় সে জঙ্গলে একটি চাকরি পেয়ে যায়। সে তথাকথিত সভ্যজগতের সাথে বনের সেতুবন্ধন। এই চরিত্রটির উপস্থিতি ছাড়া গল্পে না বলা দুই জগতের তুলনা, যা প্রায় উপন্যাসটির প্রতি জায়গায় লুকানো ছিল তা সম্ভব হত না। সত্যচরণ এই উপন্যাসটির অন্যতম প্রধান চরিত্র। যদিও তাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র মনে করাটা অনেক বড় ভুল হবে। সে একজন বহিরাগত, যার সাথে জঙ্গল অথবা জঙ্গলের লোকদের কোন সম্পর্ক নেই। জঙ্গলের রহস্যভরা মঞ্চে প্রতিদিন মঞ্চায়িত হওয়া নাটকের সে শুধুমাত্র একজন দর্শক। সে শুধুমাত্র বাইরে থেকে এই নাট্যাভিনয় দেখতে পারে, কিন্তু এতে যোগ দেওয়ার সক্ষমতা তার নেই। মূলত ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে কোন কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই। জঙ্গলই হলো এর কেন্দ্রীয় চরিত্র, যা প্রতিক্ষেত্রেই নিজের সৌন্দর্য এবং এর মধ্যে লোকজনের জীবনাচার দ্বারা নিজের পরিচয় দেয়। সত্যচরণ এই সবকিছুর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। তার প্রখর মেধা ও অনুভূতি দ্বারা সে যা কিছু দেখে তা বুঝতে ও উপভোগ করতে পারে, কিন্তু সে এসব কিছুর সাথে মিশে যেতে পারেনা। কারণ সে একজন আগন্তুক, জঙ্গলে তার কোন স্থান নেই।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।