অন্ধকারের অনেক আশ্চর্য অনুভব আছে ওর ভেতরে। এইসব অনুভব নিয়ে ওর দিনগুলো ভয়াবহ হলে ও ব্লেড দিয়ে কিছু একটা কুচিকুচি করে কাটে। সেটা কাগজ কিংবা কাপড়ের টুকরো অথবা গাছের পাতা হতে পারে। এই কুচি করার কাজটি অন্ধকারকে কেটে টুকরো করার এক ধরনের মানসিক পীড়ন। ও জানে এর থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নেই। এই পীড়ন ওকে সইতে হয়। তবু এই সওয়ার ভেতর দিয়ে এক সময়ে ও নিজেকে স্থিত করতে পারে। তারপর শুরু হয় অন্য যাত্রা। ওর মনের ভূগোলের কোনো সীমানা নেই। ওটা ওর কাছে বাউ-লেস ইউনিভার্স। ওর যাত্রা অনবরত পরিবর্তিত হয়। ও জানে এই পরিবর্তনটুকু আছে বলেই ও সরলরেখা নয়। সরলরেখা ওর কাছে নেহাৎই গৎবাধা-এটাকে অতিক্রম করতে করতে যে যাত্রা সেটাই জীবনের গন্তব্যকে নানামুখী করে। এই নানামুখী জীবনই ওর কাছে সত্য। এই সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে ও নিজের অবয়বকে ফুটিয়ে তোলে। ভাবে অন্ধকারকে অগ্রাহ্য করবে, কিন্তু পারে না। আবার ডুবে যায় অন্ধকারে। এবং অন্ধকারের ভেতরে যেখানে মাথা তোলা সেটা অন্য ভূখন্ড, যেসব ভূখন্ড ওর জীবনকে বেষ্টন করে আছে। তবু অন্ধকার হলেই ওর ভয় করে, বিশেষ করে অন্ধকার যদি গা-ছমছম করা অন্ধকার হয় তাহলে সেটা ওকে ভীষণ তাড়না করে। এমন অস্পষ্ট অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকার অভিজ্ঞতা ওর নেই, কিন্তু মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতি ওকে তেমন অভিজ্ঞতায় ঢুকিয়ে দেয়, যার সঙ্গে বাস্তবের যোগ নেই। মোহিনীর এখন তেমন সময় কাটছে। ও বুঝে যায় মানুষ ছোটবেলার অভিজ্ঞতা থেকে বেরুতে পারে না। সেটা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে স্মৃতির সবটুকু। তাছাড়া নিজের নামটাও ওকে বিব্রত করে। অনেকে না জানুক, কিন্তু ও তো জানে নামটা কিভাবে ওর পরিচয়কে একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয়। ও ইচ্ছে করলে এই নামটা বদলে অন্য একটা নাম নিতে পারতো। ওর পালক বাবা-মাকে সেটা বললেই হয়ে যেতো। কিন্তু নানা পোড়েনের ভেতরে ও নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই নামটাই ওর থাকুক। নাম ওর জীবনের গল্পকে ধরে রাখুক। এক জীবনে মানুষ তো সবকিছু পায় না, ও যা পেয়েছে তা ভালো বা মন্দ সে বিচার না করে, আড়াল করবে কেন? থাকুক। ও বারো বছর বয়সে নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় চোখের জল মুছে নিজেকেই বলেছিলো, এই নামটা থাকুক। নামটা সুন্দর। এই মুহুর্তে বাড়িতে ও একা। বাবা মা বাইরে গেছে। দাওয়াত খেয়ে ফিরবে। অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে। ওর কেন জানি মনে হচ্ছে ও দাঁড়িয়ে আছে কারো অপেক্ষায়। কেউ আসবে। হাতটা ধরবে। দরদাম হবে না ।
২১টি উপন্যাস, ৭টি গল্পগ্রন্থ ও ৪টি প্রবন্ধগ্রন্থের রচয়িতা সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। সমকালীন রাজনৈতিক সংকট ও দ্বন্দ্বের উৎস ও প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে সেলিনা হোসেন এর বই সমূহ-তে। সেলিনা হোসেন এর বই সমগ্র অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, রুশসহ একাধিক ভাষায়। প্রবীণ এ লেখিকা ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। সেলিনা হোসেন ১৯৪৭ সালের ১৪ই জুন রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। আদি পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীতে হলেও সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি তার। চাকরিসূত্রে তার বাবা রাজশাহী চলে এলে সেটিই হয়ে ওঠে সেলিনার শহর। স্থানীয় এক বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। আর ভালোবাসার টানে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সেলিনা হোসেন। এরপর সরকারি কলেজে শিক্ষকতা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনেও কাজ করেছেন তিনি। পাশাপাশি পত্রপত্রিকার জন্য চালিয়ে গেছেন তার কলম। টানা ২০ বছর তিনি ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেলিনা হোসেন মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রচনা করে পাঠকমনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তার রচিত মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক কালজয়ী উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। ‘যাপিত জীবন’, ‘ক্ষরণ’, ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’, ‘যুদ্ধ’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ (তিন খণ্ড) ইত্যাদি তার জনপ্রিয় উপন্যাস। ‘স্বদেশে পরবাসী’, ‘একাত্তরের ঢাকা’, ‘ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন’ ইত্যাদি তার জনপ্রিয় প্রবন্ধ। কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘চাঁদের বুড়ি পান্তা ইলিশ’, ‘আকাশ পরী’, ‘এক রূপোলি নদী’ সহ বেশ কিছু সুপাঠ্য গ্রন্থ। সাহিত্যাঙ্গনে এই অনবদ্য অবদানের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়াও তিনি ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’, ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’, ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ সহ অসংখ্য পদক পুরস্কার পেয়েছেন।