“শবনম" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ অধুনা উভয় বঙ্গের (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) সাহিত্য-জগতে যাহারা লেখক হিসাবে বিশেষ প্রসিদ্ধি অর্জন করিয়াছেন, ডক্টর সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৫-১৯৭৪) তাহাদের মধ্যে অন্যতম হইলেও, সাহিত্যে সংস্কৃতিবান রসসৃষ্টির বিচারে অদ্যাবধি (১৯৭৫) কেহ তাহাকে অতিক্রম করিয়া যাইতে পারেন নাই। ইহা এক দিকে যেমন মুজতবা আলীর অসাধারণ প্রতিভার জাজ্বল্যমান অভিজ্ঞান, অন্য দিকে তেমন তাঁহার পরিশীলিত রুচিরও বিশেষ পরিচায়ক। তাহার অকালমৃত্যুতে (১৯৭৪) বাংলাদেশের না, পশ্চিমবঙ্গেরও, সাহিত্য-ক্ষেত্রে যে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হইয়াছে, তাহা অতি সহজে ও সত্বর পূর্ণ হইবার নহে। সৈয়দ মুজতবা আলীর গ্রন্থের সংখ্যা ন্যূনাধিক পঁচিশ। কোন গ্রন্থকারেরই সমস্ত গ্রন্থ সমমানের হয় না। সৈয়দ সাহেবের গ্রন্থগুলিও ইহার ব্যতিক্রম নহে। তন্মধ্যে তাহার শম’ গ্রন্থটি শারদপ্রাতে গন্ধবিধুর মাঠের শেফালি-বিছানাে গালিচায় বিরহিণী নিশীথিনীর অশ্রুশিশির ‘শম'। ইহার সহিত তাঁহার অন্যান্য গ্রন্থের বিশেষ মিল নাই। এই দিক হইতে চিন্তা করিলে সহজেই উপলব্ধি হয় যে, গ্রন্থকারের ‘শম’ তাহার গ্রন্থগুলির মধ্যে অনন্য ও মনােমুগ্ধকর।
বিশিষ্ট পণ্ডিত ও রম্যরচয়িতা সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিক। শুধু রম্যরচনাই নয়, ছোটগল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, ভ্রমণকাহিনী সাহিত্যের ইত্যাদি বিশেষ শাখায় রচিত সৈয়দ মুজতবা আলী এর বই সমূহ অর্জন করেছে বিশেষ খ্যাতি। বিশেষ করে তাঁর লেখা ভ্রমণকাহিনীগুলোর জুড়ি নেই, যেগুলো পাঠকদের কাছেও ব্যাপক সমাদৃত। বিখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সিলেটের করিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস সিলেটের মৌলভীবাজারে হলেও তাঁর বাবা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলীর বদলির চাকরির সুবাদে শৈশব ও শিক্ষাজীবন কেটেছে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে৷ স্কুল-কলেজের পাট চুকিয়ে তিনি ১৯২১ সালে ভর্তি হন বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতী-তে, যেখানে তিনি অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন। এখান থেকে ১৯২৬ সালে তিনি শুধু স্নাতকই পাশ করেননি, লাভ করেছেন ইংরেজি, সংস্কৃত, ফরাসি, হিন্দি, ফারসি, জার্মান, আরবি ইত্যাদি ভাষায় দক্ষতা। এই অগাধ জ্ঞানসম্পন্ন সাহিত্যিকের পড়াশোনা এখানেই শেষ নয়, এরপর তিনি পড়াশোনা করেছেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ও মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমনকি তিনি জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্র বিষয়ে পড়েছেন বৃত্তিসহ। শুধু তা-ই নয়, ১৯৩২ সালে 'তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব' বিষয়ে গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। কর্মজীবনে তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন। সৈয়দ মুজতবা আলী এর বই ছাড়াও বেশ কিছু লেখালেখি রয়েছে, 'সত্যপীর', 'প্রিয়দর্শী' ইত্যাদি বিভিন্ন ছদ্মনামে বিভিন্ন বিখ্যাত পত্রিকায় তিনি লিখেছেন। গভীর জীবনবোধ, হাস্যরস সৃষ্টিতে পারদর্শিতা ও বিভিন্ন শ্লোক-রূপকের যথার্থ ব্যবহার সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলীর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। সৈয়দ মুজতবা আলী এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'দেশে বিদেশে', 'জলে ডাঙ্গায়' ইত্যাদি ভ্রমণকাহিনী, 'শবনম', 'অবিশ্বাস্য' ইত্যাদি উপন্যাস, 'চাচা কাহিনী', 'টুনি মেম', 'ময়ূরকণ্ঠী' ইত্যাদি ছোটগল্পগ্রন্থ এবং 'পুনশ্চ', 'ক্যাফে-দে-জেনি', 'রস-গোল্লা', 'বিধবা বিবাহ' ইত্যাদি গল্পমালা উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রয়েছে সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রবন্ধ গ্রন্থ, যার মধ্যে 'পঞ্চতন্ত্র' অন্যতম। এই অসামান্য সাহিত্যিক ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে।