‘আহমদ ছফার পাঁচটি উপন্যাস’ বইয়ের ভূমিকাঃ ‘‘আহমদ ছফা তাঁর শিল্পচর্চায় ব্যক্তির মধ্যে ইতিহাসের অতীত ও বর্তমানকে একটি বিন্দুতে নিয়ে আসেন । তাই ব্যক্তি তাঁর উপন্যাসে একটি মাত্র লোক হয়ে শেষ হয়ে যায় না, সে মানুষের ভুমিকা পালন করার দায়িত্ব লাভ কারে । ইতিহাসকে এগিয়ে নিতেও সে মানুষকে নিরন্তর চাপ দিয়ে চলেছে । এখানেও কিন্তু ছফার প্রকৃতি একজন ঔপন্যাসিকের; শুধু প্রেরণা কিংবা শুধু আবেগ নয়, শুধু বুদ্ধিবৃত্তি মননশীলতা নয়, মানুষের সমগ্র পরিচয় খুঁজে বের করার স্পৃহা তাঁর মধ্যে প্রবল । আহমদ ছফা যখন খবরের কাগজে কলাম লেখেন তখনও রোজকার তুচ্ছু ঘটনায় মানুষের এবং মানুষের বাসভূমির সমগ্র চেহারাটি দেখার উদ্যোগ নেন । বাংলাদেশের ধর্মীয় উন্মাদনা ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদকে তিনি আঘাত হানেন প্রচন্ড বিদ্রুপে । কেবল খ্যাতিমান হওয়ার মতলবে শিল্পমানশূন্য নিচু রুচির বই যখন সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতার নামে নিজের দেশবাসীকে ছোটো করে, তখনও সেই অসৎ তৎপরতাকে তিনি এতোটুকু ছাড় দেন না; ব্যঙ্গে বিদ্রপে ও তিরস্কারে জর্জরিত করে তোলেন তাকে । আঘাত করার জন্যে কৌতুক প্রয়োগে তাঁর নৈপুণ্য বাঙলা সাহিত্যে বিরল । স্বীকৃত ও গৃহীত প্রতিষ্ঠানগুলির দিকে বাঁকা চোখে তাকানো ও ঠাট্রাবিদ্রুপের মধ্যে তাদের চিহ্নিত করা এবং এই করতে করতে সত্যের আভাস পাওয়া তাঁর ঔপন্যাসিক অনুসদ্ধানের লক্ষণ । ব্যক্তির মধ্যে ইতহাসকে ও ইতিহাসে বর্তমান ব্যক্তিটিকে নিবিড় করে অনুভব করার তাগিদে পাঠক আহমদ ছফার অনুসন্ধানী অভিযানে শরিক হবেন । কাজটা প্রায়ই খুব সুখের নয়, স্বস্তিরও নয়; তাঁর রচনা পাঠককে চুবিয়ে দিতে পারে গ্লানিরোধে । আবার গ্লানি মোচনের অস্থির তাগাদও আসে আহমদ ছফার কাছ থেকেই’’ -আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
বাঙালি মুসলিম লেখকদের মধ্যে অন্যতম কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে। নিজ এলাকায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়, এবং ১৯৫৭ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও সেখানে পড়ালেখা শেষ করেননি, এবং জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অধীনে পিএইচডি শুরু করলেও তা আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি। আহমদ ছফা এর বই সমূহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাঠকদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বই হিসেবে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। আহমদ ছফা এর বই সমূহের মাঝে 'ওঙ্কার', 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী', 'বাঙালি মুসলমানের মন', যদ্যপি আমার গুরু', 'গাভী বিত্তান্ত' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো জার্মান সাহিত্যিক গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম 'ফাউস্ট' বাংলায় অনুবাদ করা। আহমদ ছফা এর বই সমগ্র একত্রিত করে রচনাবলি আকারে ৯টি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই সাহিত্যিক 'লেখক শিবির পুরস্কার' ও বাংলা একাডেমির ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’ পেলেও সেগুলো গ্রহণ করেননি। এই পাঠকনন্দিত সাহিত্যিক ২০০১ সালের ২৮ জুলাই ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর 'একুশে পদকে' ভূষিত হন।