"আহমদ ছফার প্রবন্ধ"বইটির ভূমিকা: এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত রচনাগুলাে উনিশশাে ছেষট্টি থেকে উনিশশাে বিরানব্বই সালের মধ্যবর্তী সময়ে লিখিত। একজন মানুষের জীবনে তিরিশ বছর বড়াে কম সময় নয়। এই সময়ের পরিসরে আমার চিন্তাভাবনার মধ্যে কি ধরনের বিবর্তন ঘটেছে, তার একটা পরিচয় নিশ্চয়ই প্রবন্ধগুলাের মধ্যে পাওয়া যাবে। দুটো মূল রচনা এবং একটি অনুবাদ প্রবন্ধ ছাড়া অন্যান্য লেখা ইতিপূর্বে নানা সময়ে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ গ্রন্থ (ক) বাংলাভাষা রাজনীতির আলােকে (খ) বাঙালী মুসলমানের মন’ এবং (গ) শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য প্রবন্ধের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলাে। এই গ্রন্থ তিনটিতে সাহিত্য বিষয়ক রচনা ছাড়াও সামাজিক রাজনৈতিক ও সমকালীন প্রসঙ্গের ওপর লেখা বেশ কিছু রচনা স্থান পেয়েছে। শুধু সাহিত্যবিষয়ক রচনাগুলাে বেছে নিয়ে এই গ্রন্থে সংকলিত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ পুস্তক সমূহে স্থান পাওয়া অন্য ধরনের লেখাগুলাে নিয়ে আরাে দুটো সংকলন. এই বছরে একই সময়ে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আমার পূর্ব প্রকাশিত প্রবন্ধ পুস্তক সমূহের সবগুলাের নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হবে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। মুখ্যতঃ সে কারণে পূর্বে প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ তিনটি যাদের উৎসর্গ করেছিলাম সেই নামগুলাে বর্তমান সংকলনের ভূমিকায় উল্লেখ করা একটি কর্তব্য বলে মনে করি। বাংলাভাষা রাজনীতির আলােকে’ গ্রন্থটি আমি বেগম হুসনে আরা হক এবং আজিজুল হক সাহেবের নামে উৎসর্গ করেছিলাম। বাঙালী মুসলমানের মন’ গ্রন্থটি জনাব লুতফর রহমান সরকার এবং আমার প্রকাশক বন্ধু প্রয়াত মােস্তফা কামালের নামে উৎসর্গ করা হয়েছিলাে। শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য প্রবন্ধের উৎসর্গের পাতায় প্রীতিভাজন কাজী আকরম হােসেনের নাম উল্লেখ করা হয়েছিলাে। মূলতঃ মানুষ এবং নজরুলের কাছে আমাদের ঋণ’ এ রচনা দুটো পূর্বের কোনাে গ্রন্থে স্থান পায়নি। অপেক্ষাকৃত সাময়িককালে রচনা দুটো লেখা হয়েছে। মূলতঃ মানুষ’ লেখাটি সাপ্তাহিক উত্তরণে প্রকাশিত হয়েছিলাে। নজরুলের কাছে আমাদের ঋণ’ লেখাটি ১৯৬৯ সালের নজরুল জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমীতে পাঠ করার জন্য লেখা হয়েছিলাে। পরে লেখাটি কাব মুস্তফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা সুন্দরম' এ রূপা হয়েছিলাে। পত্র পত্রিকার সম্পাদকবৃন্দ এবং পূর্ববর্তী প্রবন্ধ গ্রন্থসমূহের প্রকাশকদের কাছে আমি অপরিসীম ঋণে ঋণী। মুদ্রণের সময় লেখাগুলাের এম প্রকাশের কালানুক্রম রক্ষিত হয়নি। বিষয়ের প্রতি প্রাধান্য দেয়ার কারণেই "বইটির সূ চি প ত্র: শতবর্ষের ফেরারি-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৩ বাঙালী মুসলমানের মন ৫১ বাংলার চিত্র ঐতিহ্য : সুলতানের সাধনা ৬৯ বাংলা ভাষা : রাজনীতির আলােকে ৯২ ভাষা বিষয়ক চিন্তাভাবনা ১০৭ বাংলার সাহিত্যাদর্শ ১১৪ রবীন্দ্রনাথ ১২৪ নজরুলের কাছে আমাদের ঋণ ১২৯ মূলতঃ মানুষ ১৪০ মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র ১৪৫ জীবনানন্দ দাশ : তার কাব্যের লােকজ উপাদান : সাম্প্রতিক নিরিখ ১৫০ গ্যোতে ও রবীন্দ্রনাথ ১৫৬ গ্যোতে-প্রাচ্য প্রতীচ্যের প্রেক্ষিতে ১৬০ গ্যোতে-জনৈক বাঙালীর দৃষ্টিতে ১৬৩ বাট্রাণ্ড রাসেল ১৬৮ টি, ই লরেন্স-বীরত্বের ওপর পর্যালােচনা ১৭৫
বাঙালি মুসলিম লেখকদের মধ্যে অন্যতম কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে। নিজ এলাকায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়, এবং ১৯৫৭ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও সেখানে পড়ালেখা শেষ করেননি, এবং জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অধীনে পিএইচডি শুরু করলেও তা আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি। আহমদ ছফা এর বই সমূহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাঠকদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বই হিসেবে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। আহমদ ছফা এর বই সমূহের মাঝে 'ওঙ্কার', 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী', 'বাঙালি মুসলমানের মন', যদ্যপি আমার গুরু', 'গাভী বিত্তান্ত' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো জার্মান সাহিত্যিক গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম 'ফাউস্ট' বাংলায় অনুবাদ করা। আহমদ ছফা এর বই সমগ্র একত্রিত করে রচনাবলি আকারে ৯টি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই সাহিত্যিক 'লেখক শিবির পুরস্কার' ও বাংলা একাডেমির ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’ পেলেও সেগুলো গ্রহণ করেননি। এই পাঠকনন্দিত সাহিত্যিক ২০০১ সালের ২৮ জুলাই ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর 'একুশে পদকে' ভূষিত হন।