মানুষের জীবনকে সুখী ও স্বাচ্ছন্দময় করার জন্য পৃথিবীতে বহু ধর্ম ও দর্শনের আবির্ভাব হয়েছে। এসব ধর্ম-দর্শন জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যা দেয়। মানবজীবনের কল্যাণ ও নৈতিকতার পথ দেখায়। সকল ধর্ম-দর্শন মানুষকে কতিপয় আদর্শ ও মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়। সকল ধর্মই সত্য, ন্যায়, উদারতা, বিনয়, পরার্থপরতা, সহযোগিতা ও সহানুভূতির গুণ অর্জন করতে এবং হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা, শঠতা, সংকীর্ণতা, শত্রুতা ও মিথ্যা বর্জন করতে শিক্ষা দেয়। বিভিন্ন ধর্ম-দর্শনে এসব জাগতিক বিষয়ে ঐক্য থাকলেও মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে রয়েছে বিস্তর ফারাক। কিছু দার্শনিক, প্রকৃতিবাদী বিজ্ঞানী ও মনস্তত্ত্ববিদ মৃত্যু-পরবর্তী জীবনকে অস্বীকার করেন। তারা মনে করেন, মৃত্যুর পর মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর আর কোনো জীবন নেই। তাদের মতে, অন্যান্য বস্তুর মতো মানুষও ভৌত-রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার দ্বারা পরিচালিত হয়। মানবদেহের ভৌত-রাসায়নিক প্রক্রিয়া যখন ব্যর্থ হয়, তখন মানুষের মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর পর আর কোনো কিছু অবশিষ্ট থাকে না। তবে বিশে^র প্রায় প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে বিশ্বাসী। এসব ধর্মমত অনুসারে দেহ ও আত্মা নিয়ে মানবজীবন। আর দেহ থেকে আত্মার বিচ্ছিন্নতা হচ্ছে মানুষের মৃত্যু। আবার মৃত্যু-পরবর্তী আত্মা ও দেহ নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে রয়েছে পার্থক্য। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্মে বিশ্বাসীরা পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করে। তাদের মতে মোক্ষ লাভ না করা পর্যন্ত মানুষ নিজস্ব কর্মফল ভোগ করার জন্য বার বার এ পৃথিবীতে দেহ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। অসৎকাজ করলে পরজন্মে মানবেতর জীবন নিয়ে কিংবা নিকৃষ্ট স্তরের মানুষ হয়ে জন্মাবে। আর যদি ভালো কাজ করে, তাহলে আরো উঁচুস্তরের মানুষ হয়ে জন্মাবে। হিন্দু মত অনুসারে পৃথিবীর জীবনে মানুষ পাপ-পুণ্য যাই করুক, তার ফল ভোগ করতে হয়। মানুষ যখন নিরাসক্ত কর্ম করতে সক্ষম হয়, যখন কোনো প্রকার কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা দ্বারা তাড়িত না হয়ে কর্ম করে, তখন তার মোক্ষ লাভ হয়। আর মোক্ষলাভের পর মৃত্যু হলে তাকে আর পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে হয় না। তখন সে ব্রহ্মের সাথে গিয়ে মিলিত হয় এবং পরমানন্দ উপভোগ করে। মরণোত্তর জীবন সম্পর্কে তৃতীয় মত হচ্ছে আখিরাত তথা কবরের শান্তি কিংবা শাস্তি, কিয়ামত, পুনরুত্থান, আল্লাহ তা‘আলার আদালতে উপস্থিতি, বিচার এবং পৃথিবীর জীবনের কৃতকর্মের প্রতিফল স্বরূপ জান্নাত অথবা জাহান্নাম লাভ। এটা হচ্ছে ইসলাম, ইহুদি, খ্রিষ্টধর্মসহ অন্যান্য সকল নবী-রাসূলের প্রচারিত মত। ইসলামী আদর্শ অনুসারে পৃথিবীতে মানুষ যেমন ক্ষণস্থায়ী, তেমনি মহাবিশ্ব ও এর মধ্যে যা কিছু আছে সবই ক্ষণস্থায়ী। এ জগৎ শূন্য হতে সৃষ্টি হয়ে, ক্ষুদ্রতর অবস্থা হতে সম্প্রসারিত হয়ে বিশাল আকৃতি লাভ করেছে। যা আজও সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু একদিন এ জগৎ এবং এর মধ্যস্থিত সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সত্তা অবশিষ্ট থাকবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এক উচ্চতর পর্যায়ের ও উৎকৃষ্টমানের জগৎ তৈরি করবেন যা হবে চিরস্থায়ী। আখিরাত বা মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ইসলামী বিশ্বাস বা মতবাদ মানুষের পার্থিব জীবনের কল্যাণের জন্য খুবই জরুরি। এতে কোনোরকম অকল্যাণ নেই। আখিরাতের মতবাদ পৃথিবীতে মানুষকে ভালোকাজের প্রেরণা জোগায় ও মন্দকাজ হতে বিরত রাখে। সৃষ্টিজগতের সব বস্তুরই একটি লক্ষ্য ও শেষ পরিণতি রয়েছে। সুতরাং মানুষেরও একটি উদ্দেশ্য ও শেষ পরিণতি রয়েছে। আর তা হচ্ছে স্রষ্টার আনুগত্য করা। এর ফলস্বরূপ আখিরাতের জীবনে জান্নাত লাভ। এমনটি তো হতে পারে না যে, সৃষ্টি জগতের সেরা সৃষ্টি মানুষ কেবল জন্ম নেবে, পানাহার করবে, কিছুদিন পর মরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং কোনো পরিণতি ব্যতিরেকে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদে বর্ণিত হয়েছে, “তোমরা কি মনে করেছো যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্ট করেছি এবং তোমরা আমার নিকট ফিরে আসবে না? নিখিল জগতের প্রকৃত মালিক আল্লাহ উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছু করার স্তর হতে অনেক ঊর্ধ্বে। পবিত্র আরশের অধিপতি মহান প্রভু ছাড়া আর কোনো ইলাহ্্ নেই” (২৩ : ১১৫-১১৬)।