বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী ও প্রতিভাবান সাহিত্য সমালোচক আজফার হোসেন তাঁর এই গ্রন্থে বিদ্যাসাগর থেকে বুদ্ধদেব — এবং মধুসূদন থেকে মানিক— পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসরে মোট তেইশটি রচনায় বাংলা সাহিত্যের প্রভাবশালী লেখকদের রাজনৈতিক ও আন্তঃশাস্ত্রীয় পাঠ হাজির করেছেন। বন্দনার চেয়ে বিশ্লেষণকে প্রাধান্য দিয়ে, অমূলক অভিবাদন ও অন্ধ অভিযোগের 'বাইনারি'কে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং সনাতন সমালোচনা পদ্ধতির দুর্লঙ্ঘ সীমান্ত অতিক্রম করে আজফার হোসেন সংস্কৃতি ও সাহিত্যের তুলনামূলকভাবে উপেক্ষিত এলাকার ওপর যেমনি তাঁর ইতিহাস-সচেতন ও রাজনীতিমনস্ক চোখ নিবদ্ধ রেখেছেন, তেমনি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি প্রশ্ন করেছেন সমসাময়িক সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক এস্টাব্লিশমেন্টকে। অনাবিল যুক্তি ও তীক্ষ্ণ পর্যালোচনার মাধ্যমে তিনি যথার্থই প্রমাণ করেছেন, সাহিত্য ও সাহিত্য সমালোচনা মোটেই রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শিকভাবে নিরীহ ও নিরপেক্ষ কোনো অনুশীলন নয়; আর তিনি জোর দিয়েছেন সাহিত্য সমালোচনার বিউপনিবেশায়নের গণতান্ত্রিক প্রয়োজনীয়তার ওপর। তুলনামূলক সাহিত্যের একাধিক এলাকায় প্রবেশ করে আজফার হোসেন সাহিত্য সমালোচনার নতুন পথ নির্দেশ করেছেন, আর এই বইয়ে তাঁর আলোকসঞ্চারী প্রখর চিন্তাচিত্র গতি ও স্ফূর্তি পেয়েছে তুখোড় ও তেজস্বী ভাষায়। যাঁরা সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে জীবন ও রাজনীতির বৃহত্তর পরিসরে বুঝতে চান, আর সে কারণে বাংলা সাহিত্যের প্রভাবশালী লেখকদের বিকল্প পাঠে আগ্রহী, তাঁদের জন্য পাঠ : শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের রাজনীতি একটি অপরিহার্য গ্রন্থ।
আজফার হোসেন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত বাংলাদেশী-অ্যামেরিকান তাত্ত্বিক, সমালোচক, অ্যাকাডেমিক, দ্বিভাষিক লেখক, কবি, অনুবাদক ও জনবুদ্ধিজীবী আজফার হোসেন বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটি-তে ইনটিগ্রেটিভ/ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজ-এ অধ্যাপনা করছেন এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সোশ্যাল ইনোভেশান' বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ-এর পরিচালক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি আজফার হোসেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'গ্লোবাল সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ'-এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসাবে বর্তমানে কাজ করছেন এবং সেখানে তিনি ইংরেজি, বিশ্বসাহিত্য এবং ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজ-এর অধ্যাপকও। এছাড়া তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস-বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এ 'সামার ডিস্টিংগুয়িশড প্রফেসর অব ইংলিশ ও হিউম্যানিটিজ' হিসাবেও প্রায় প্রতিবছর পড়িয়ে থাকেন। আজফার হোসেন ইংরেজি সাহিত্য, কালচারাল স্টাডিজ এবং এথনিক্ স্টাডিজ পড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি, বৌলিং গ্রিন স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটি-তে। পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে, যেখান থেকে তিনি শীর্ষস্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে 'ডিসটিংস'সহ তিনি ইংরেজি ও বিশ্বসাহিত্যে এম এ ও ডক্টরেট করেন। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় তিনি লিখে থাকেন। ভাষা, সাহিত্য, সাহিত্যতত্ত্ব, সংস্কৃতি, দর্শন, ইতিহাস, রাজনৈতিক অর্থনীতি, এবং রাজনীতি-সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি কয়েকশ' প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখেছেন, যেগুলো বিভিন্ন সময়ে দেশে ও বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি ভাষা থেকে তার ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে। বাংলায় ও ইংরেজিতে তার কবিতাও প্রকাশিত হয়েছে, যেমন প্রকাশিত হয়েছে তার বেশ কিছু ব্যঙ্গরচনা এবং ট্র্যাভেলগ। বাংলাদেশে থাকাকালীন তিনি প্রচুর রাজনৈতিক কলাম লিখেছেন এবং একাধিক পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যুক্ত ছিলেন, যেমন তিনি নব্বইয়ের দশকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সময় পত্রিকাটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন এবং ইংরেজি সাপ্তাহিক সানডে এক্সপ্রেস-এর প্রদায়ক সম্পাদক ছিলেন। এক সময় তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবিরের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবেও কাজ করেছেন। নিউইয়র্ক-এর হার্টকোর্ট ব্রেইস থেকে প্রকাশিত সংকলন রিডিং অ্যাবাউট দ্য ওয়ার্ল্ড (১৯৯৯)-এর দুই খণ্ড সম্পাদনা করেছেন পল ব্রায়ানস্-এর সঙ্গে। এছাড়া তিনি ইংরেজিতে লিখেছেন একাধিক বই। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস-এর সঙ্গে আন্তঃশাস্ত্রবিদ্যাবিষয়ক তাঁর একটি বই প্রকাশের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাঁর বই ‘দর্শনাখ্যান’ (সংহতি, ২০১৯) প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে পাঠকমহলে তুমুল সাড়া জাগিয়েছিল, যেমন একইভাবে সাড়া জাগিয়েছে তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত বই ‘চিহ্ন ভাসে অবশেষে’ (পুণ্ড্র প্রকাশন, ২০২৩)। এছাড়াও তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘The World in Question : Essays in Political Economy and Cultural Politics’ (সংহতি, ২০০৮) এবং ‘পাঠ: শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের রাজনীতি’ (সংহতি, ২০২২)। শিগগিরই বেরুচ্ছে তাঁর আরো দুটি বই: ‘সাম্রাজ্যবাদ ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি’ (সংহতি, ২০২৪) ও ‘কেরামতনামা’ (পুণ্ড্র প্রকাশন, ২০২৪)।