উত্তর আফ্রিকা একটি প্রাচীন জনপদ। এর সীমারেখা নিয়ে ঐতিহাসিকদের অনেক মতামত রয়েছে। বর্তমান এটি মাগরিবে আরাবি নামে পরিচিত। এর অধীনে রয়েছে লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো এবং মৌরিতানিয়া। খ্রিষ্টপূর্ব যুগ থেকেই সেখানে জনবসতি গড়ে ওঠে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এতদঞ্চল আবাদ করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বার্বার, আফ্রিকান, সুদান, কারামানতি, ফিনিশিয়ান, কার্টেজিনা, রোমান, ফ্রাঙ্ক এবং ভানদাল জাতি। এসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে অগ্নিপূজা, ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মের চর্চা হতো। ২২ হিজরি মোতাবেক ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে এ অঞ্চলে ইসলামের বিজয়ী আগমন ঘটে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর রা.-এর প্রতিনিধি আমর ইবনুল আস রা. লিবিয়া অভিমুখে অভিযানে বের হন। তিনি একের পর এক বারকা, ত্রিপোলি, সাবরাতাহ ও শারুস শহর জয় করেন। তখন রণকৌশল হিসেবে উমর রা. তাঁকে অভিযান স্থগিত করে মিসরে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। উসমান রা. খেলাফতের দায়িত্বগ্রহণের পর ২৬ হিজরি/৬৪৬ খ্রিষ্টাব্দে আবদুল্লাহ ইবনু সাদ রা.-কে আফ্রিকায় অভিযানে পাঠান। তিনি তিউনিসিয়া জয় করে মিসরে ফিরে যান। এরপর মুআবিয়া ইবনু আবু সুফিয়ান রা.-এর শাসনামল তথা ৪৫ হিজরি/৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মুআবিয়া ইবনু হুদাইজ রা. আফ্রিকায় অভিযান পরিচালনা করে বিজার্ট, সোস ও জালাওলা শহর জয় করেন। এছাড়াও তিনি ‘কারন’ পর্বতের পাদদেশে জনবসতি গড়ে তোলেন এবং সে স্থানের নাম দেন ‘কায়রাওয়ান’। ৫০ হিজরি/৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে উকবা ইবনু নাফি তদঞ্চলে অভিযানে বের হন। তিনি মরক্কো জয় করেন এবং মুআবিয়া ইবনু হুদাইজ রা.-এর নির্বাচিত স্থান থেকে একটু দূরে সরে ইসলামের প্রথম শহর ‘কায়রাওয়ান’ নির্মাণ করেন। সেসময় এ শহরটি মুসলিমদের জিহাদি আন্দোলনের ঘাঁটি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। এ শহরে ইসলামের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন হয়। এরপর তিনি তিলিমসান, তিয়ারেত, তানজিয়া, ওয়াল্লিলি, সোস আল-আদনা, সোস আল-আকসা এবং উত্তর আফ্রিকার শেষ ভূখণ্ড মালিয়ান শহর জয় করেন। তাঁর শাহাদাতের পর মধ্য-আফ্রিকা ও দূর-আফ্রিকা অভিযান পরিচালনা করেন আবুল মুহাজির দিনার, যুহাইর ইবনু কায়স বালাভি, হাসসান ইবনু নু‘মান আযদি গাসানি, মুসা ইবনু নুসাইর লাখমি। এতদঞ্চলের অভিযানে আরও বহু সাহাবি অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইর রা. এবং রুওয়াইফা ইবনু সাবিত আনসারি রা.। বক্ষ্যমাণ বইটিতে উল্লিখিত মুসলিম মহাবীরদের ঈমানদীপ্ত বিজয়াভিযানের রোমাঞ্চকর ঘটনাগুলো আলোকপাত করা হয়েছে। তাদের নেতৃত্বগুণাবলি, সমরনীতি ও রণকৌশল তুলে ধরা হয়েছে। বিজিত অঞ্চলে ইসলামি শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ভূখণ্ড জয়ের পাশাপাশি সেখানকার বাসিন্দাদের হৃদয় জয় করতে তাদের নীতি-নৈতিকতা, সততা, মহানুভবতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার অনুসরণীয় আদর্শ আলোচনা করা হয়েছে। দীন-প্রচারের উদ্দেশ্যে তদঞ্চলে আগত দাঈ সাহাবিদের পরিচয় এবং কায়রাওয়ান শহরকে কেন্দ্র করে তাদের জ্ঞানচর্চার কথা উঠে এসেছে।
ফকিহ, রাজনীতিক ও বিশ্বখ্যাত ইতিহাসগবেষক। ইসলামের ইতিহাসের উপর বিশ্লেষণধর্মী তাত্ত্বিক গ্রন্থ রচনা করে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। এই মহা মনীষী ১৯৬৩ সনে লিবিয়ার বেনগাজি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা বেনগাজিতেই করেন। যৌবনের প্রারম্ভেই গাদ্দাফির প্রহসনের শিকার হয়ে শায়খ সাল্লাবি আট বছর বন্দি থাকেন। মুক্তি পাওয়ার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি সাউদি আরব চলে যান। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়া ও উসুলুদ্দিন বিভাগ থেকে ১৯৯৩ সনে অনার্স সম্পন্ন করেন। তারপর চলে যান সুদানের উম্মু দুরমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে উসুলুদ্দিন অনুষদের তাফসির ও উলুমুল কুরআন বিভাগ থেকে ১৯৯৬ সনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৯৯ সনে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘ফিকহুত তামকিন ফিল কুরআনিল কারিম’। ড. আলি সাল্লাবির রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু বিশ্বখ্যাত ফকিহ ও রাজনীতিক ড. ইউসুফ আল কারজাবি। কারজাবির সান্নিধ্য অর্জনে তিনি ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কাতার গমন করেন। নতুন ধারায় সিরাত ও ইসলামি ইতিহাসের তাত্ত্বিক গ্রন্থ রচনা করে ড. আলি সাল্লাবি অনুসন্ধিৎসু পাঠকের আস্থা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। নবিজির পুর্ণাঙ্গ সিরাত, খুলাফায়ে রাশিদিনের জীবনী, উমাইয়া খিলাফত, আব্বাসি খিলাফত, উসমানি খিলাফতের উত্থান-পতনসহ ইসলামি ইতিহাসের সাড়ে তেরোশ বছরের ইতিহাস তিনি রচনা করেছেন। তা ছাড়া ইসলামি ইতিহাসে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করা ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি আলাদা আলাদা গ্রন্থ রচনা করেছেন। ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবির রচনা শুধু ইতিহাসের গতানুগতিক ধারাবর্ণনা নয়; তাঁর রচনায় রয়েছে বিশুদ্ধতার প্রামাণিক গ্রহণযোগ্যতা, জটিল-কঠিন বিষয়ের সাবলীল উপস্থাপনা ও ইতিহাসের আঁকবাঁকের সঙ্গে সমকালীন অবস্থার তুলনীয় শিক্ষা। এই মহা মনীষী সিরাত, ইতিহাস, ফিকহ ও উলুমুল কুরআনের উপর আশির অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচনাবলি ইংরেজি, তুর্কি, ফরাসি, উর্দু ও বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে পৃথিবীর জ্ঞানগবেষকদের হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। আল্লাহ তাঁকে দীর্ঘ, নিরাপদ ও সুস্থ জীবন দান করুন। আমিন। —সালমান মোহাম্মদ লেখক, অনুবাদক ও সম্পাদক ২৪ মার্চ ২০২০