"সেকালের সিলেট" বইটির 'জীবনের সীমানায় দাঁড়িয়ে' অংশ থেকে নেয়াঃ এখন বয়স ঠেকল নব্বইয়ের ওপরে; এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় পেয়েছি অগণন মানুষের অফুরন্ত ভালােবাসা। জীবনের নানা গিরিখাদ-চড়াই-উতরাই পার করে এখনও মানুষের মাঝে থাকতে চাই, কাজ করতে চাই তাদের হয়ে; আজো ফোটে নি মানুষের মুখে হাসি। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখলাম সৎলােকদের সাহসী ভূমিকা দরকার। প্রয়ােজন সংঘবদ্ধ শক্তি, গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক চেতনা আর অসাম্প্রদায়িক মানবিক শক্তির লালন। সরকারি আইনকানুন মানুষের সর্বময় কল্যাণের জন্য হওয়া চাই; না হলে চলবে না। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষুদ্রতা ও অদূরদর্শী চিন্তা হলে সামাজিক উন্নয়ন ও বদ্ধতা কাটবে। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল তারপর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় তিন যুগ। দেখলাম; কিন্তু গুণগত পরিবর্তন কতটুকু হয়েছে তা বলা কঠিন। আজো গ্রাম দেখি শ্রীহারা। নারী নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছে বই কমছে না; নতুন করে অত্যাচার আবির্ভূত হচ্ছে। সেই যে ব্রিটিশ আমল থেকে সাম্প্রদায়িক চেতনার লালন চলেছিল তারই কুফল দেখলাম হিন্দু-মুসলমানের মানসিক ফাঁকের দূরত্বে। দেখলাম উপমহাদেশের রাজনীতির টানাপােড়েন ও পারস্পরিক অশ্রদ্ধাবােধ। এখনাে সেই আগুন ভেতরে ভেতরে সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে; ঝেড়ে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। এসব কারণে নির্মম যন্ত্রণার শিকার হলাে সাধারণ মানুষ। তারা রয়ে গেল সেই একই জায়গায়। এ শতাব্দীতে উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজ করা দরকার। সিলেটে নারী শিক্ষার সূচনা ও মহিলাদের রাজপথে আসার সেই শুভক্ষণ আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে; কিন্তু জীবন সায়াহ্নে দেখছি এখনাে মেয়েরা রয়েছে পশ্চাতে। তাদেরকে স্বাবলম্বী ও সাহসী হয়ে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমার কোনাে আত্মজীবনী লেখার পরিকল্পনা ছিল না বা নেই। দীর্ঘ জীবনে এমন কিছু করি নি যা নিয়ে লেখা যাবে বৃহৎ কোনাে সামাজিক-ইতিহাস; কিন্তু দেখেছি বিস্তর। উষাকালের সর্বভারতীয় ও আমাদের জাতীয় নেতা প্রায় সবাইকে দেখেছি; কাউকে কাউকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। লেখালেখির অভ্যাস না থাকায় অনেক কিছু তলিয়ে গেছে। তবে আমার লেখা কয়েকটি ডায়েরিকে কেন্দ্র করে এবং স্মৃতির ওপর ভর করে নানা সময় স্নেহাস্পদ দীপংকরকে যে গল্প ও অভিজ্ঞতার কথা বলতাম, সেই সব ছন্নছাড়া ও অগােছালাে কথাকে সে সাজিয়ে তুলেছে এমন করে। বৃদ্ধ বয়সে একান্তে বসলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই সব দিন ও মানুষের ছবি, যাদের কারণে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীনতা। এই বইটি সম্পূর্ণ আত্মকথা নয়; নয় স্মৃতিচারণ কিংবা ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ। গল্পচ্ছলে বলা সেকালের সিলেটের খণ্ডচিত্র মাত্র।