'হাকীমুল উম্মতের কথা' বেহেশতী গাওহার নামক এই রেসালাটি বেহেশতী জেওরের পরিশিষ্ট। বেহেশতী জেওর ইতিপূর্বে দশ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। শেষ খন্ডের সমাপ্তিলগ্নে একটি পরিশিষ্টের দরকার মনে হচ্ছিল। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে তার মাসাইল সমূহ বড় বড় দালিলিক কিতাব হতে চয়ন করে একত্রিত করা সম্ভব হয়নি। তাই লাখনৌ থেকে প্রকাশিত ইলমুল ফিকাহ নামক রেসালাটি ছাত্রসুলভ দৃষ্টিতে মুতালাআ করি। রেসালাটিতে অধিকাংশ জায়গায় মূল কিতাবের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে পুরুষদের সাথে সংশ্লিষ্ট জরুরী মাসাইল এবং তার সাথে আনুসঙ্গিক প্রয়োজন বিবেচনা করে পুরুষ-মহিলা উভয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট জরুরী মাসাইল সমূহ চয়ন করে বেহেশতী জেওরের পরিশিষ্ট হিসেবে লিখে দেওয়াই যথেষ্ট মনে করি। এই পরিশিষ্ট লিখতে গিয়ে শুধু ইলমুল ফিকাহ রেসালার উপরই পূর্ণ নির্ভর করা হয়নি, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে মূল কিতাবাদি দেখে নিশ্চিত হয়ে মাসআলা গ্রহণ করা হয়েছে। আর ইলমুল ফিকাহ্ রেসালার যে স্থানগুলোতে বিষয়বস্তু ও কিতাবের উদ্ধৃতির ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল সেগুলোরও সংশোধন করে দেওয়া হয়েছে। কোন কোন স্থানে প্রয়োজন বোধে সংযোজন-বিয়োজন, শাব্দিক পরিবর্তন বা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। সুতরাং বেহেশতী গাওহার নামক রেসালাটি একটি পরিশিষ্ট হিসেবে স্বয়ংসম্পূর্ণ কিতাব নয়, আবার ভিন্ন বিবেচনায় তা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কিভাবে পরিণত হয়েছে। আর কিছু জরুরী মাসাইল সাফাইয়ে মুআমালাত নামক কিতাব থেকেও গ্রহণ করা হয়েছে। এদতসত্ত্বেও কিছু জরুরী মাসাইল বাদ পড়ে যাওয়াই সাভাবিক। তাই সাধারণ পাঠকবৃন্দের কাছে বাদ পড়ে যাওয়া মাসাইলগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন আকারে অবহিত করার জন্য আবেদন রইল, যাতে পরবর্তী সংস্করণে সেগুলো সংযোজন করে দেওয়া যায়। বিশেষ করে উলামায়ে কিরামের খিদমতে এ আশা রাখি যে, তারা প্রয়োজনীয় জায়গাগুলোতে নিজেদের পক্ষ থেকেই মাসাইল সংযোজন করে নিবেন। যেমন মূল কিতাবের দশম খন্ডের শেষে যমীমাহ বা সম্পূরক হিসেবে কিছু মাসাইল সংযোজন করা হয়েছে।
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এর গন্ডি পেরিয়ে যিনি হাজারো মানুষকে দিয়েছেন আত্মশুদ্ধি ও তাসাওউফ এর শিক্ষা। যার কারণে তাঁর উপাধি ছিলো ‘হাকীমুল উম্মাত’ বা উম্মাহর আত্মিক চিকিৎসক। উপমহাদেশে মুসলমানদের মাঝে সুন্নতের জ্ঞান প্রচারে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘দাওয়াতুল হক’ এর অবদানের জন্যও প্রসিদ্ধ মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর নাম। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী ১৯ আগস্ট, ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে (রবিউস সানী ৫, ১২৮০ হিজরী) ভারতের উত্তর প্রদেশের থানাভবনে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই হাফেয হোসাইন আলী রাহ.-এর কাছে সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন। নিজগ্রামেই ছোটবেলায় হযরত মাওলানা ফতেহ মুহাম্মদ থানভী রাহ.-এর কাছ থেকে আরবি ও ফার্সি ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১২৯৫ হিজরীতে তিনি দারূল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখাগুলোয় বিচরণ করার আগ্রহে। সেখানে তিনি পাঁচ বছর হাদীস, তাফসীর, আরবি সাহিত্য, ইসলামী দর্শন, যুক্তিবিজ্ঞান, ইসলামি আইন এবং ইতিহাস বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। দেওবন্দে শিক্ষার অধ্যায় সমাপ্ত করে মক্কা মুকাররমায় মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কীর কাছে কেরাত ও তাজবীদ শেখেন। তিনি কানপুরের একটি মাদ্রাসায় মাত্র ২৫ টাকা বেতনে শিক্ষকের পদ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে কানপুরের টপকাপুরে জামিউল উলূম মাদ্রাসার প্রধান পরিচালকের আসন অলংকৃত করেন এবং দীর্ঘ ১৪ বছর সেখানে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তাঁর শিক্ষক হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর রহ. পরামর্শে তিনি থানা ভবনের খানকাহে ইমদাদিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। সারা জীবনে আশরাফ আলী থানভী এর সকল বই এর হিসেব করতে গেলে ছোট-বড় মিলিয়ে তা সাড়ে বারো হাজার ছাড়িয়ে যায়। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমূহ এর মধ্যে ফিকাহ বিষয়ক বই ‘বেহেশতী জেওর’ উপমহাদেশের মুসলমানদের মাঝে বহুল পঠিত। এছাড়া তাঁর রচিত কুরআন শরীফের উর্দু তরজমার গ্রন্থ বয়ানুল কুরআনও (কুরআনের ব্যাখ্যা) এর ভাষা ও ব্যখ্যাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমগ্র এর স্বত্ত্ব তিনি জাতির কল্যাণে উন্মুক্ত করে রেখে গেছেন। জুলাই ১৯, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে (১৬ রজব, ১৩৬২ হিজরী) আল্লামা থানভী রহ. তাঁর জন্মস্থান থানা ভবনেই মৃত্যুবরণ করেন।