সিরাজুদ্দীন হোসেনের সাংবাদিকতা জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ তাঁর উপসম্পাদকীয় কলাম ‘মঞ্চে-নেপথ্যে’। ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে লেখা অনবদ্য এই রচনাগুলোয় উঠে এসেছে তৎকালীন রাজনীতির তীক্ষè পর্যবেক্ষণ ও বিচার বিশ্লেষণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা কেন জনগণের দাবি, তার বিশ্লেষণ রয়েছে এখানে। করা হয়েছে ভণ্ড, কায়েমী স্বার্থবাদীদের মুখোশ উন্মোচন। নতুন প্রজন্মের পাঠকদের কাছে বড়ো একটি প্রাসঙ্গিক ভূমিকাসহ সিরাজুদ্দীন হোসেনের ‘মঞ্চে-নেপথ্যে’ কলাম তুলে ধরার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করতে গেলে সিরাজুদ্দীন হোসেনকে যে অগ্রাহ্য করে যাওয়া যায় না, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। মানুষ তাঁর নিজের স্বার্থ রক্ষা করেই ইতিহাস রচনা করে। ইতিহাসে সে নিজের পছন্দের উপাদানগুলোই দেখতে চায়। আমরা চেষ্টা করেছি, নির্মোহ দৃষ্টিতে তৎকালীন রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও অর্থনীতির নিরিখে সিরাজুদ্দীন হোসেনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করতে। আওয়ামী লীগ, ইত্তেফাক, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, এই বন্ধনগুলো ঠিকভাবে বুঝতে না পারলে ইতিহাসের মূল সূত্রই হারিয়ে যাবে। এই বই প্রকাশের মাধ্যমে আমরা সেই মূল জায়গায় ফিরে আসার একটি পথ তৈরি করলাম মাত্র। বাকি কাজ নতুন যুগের ইতিহাসপ্রেমীদের। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এতদ্ঞ্চলের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সিরাজুদ্দীন হোসেনের আবির্ভাব ঘটেছিলো যুগস্রষ্টা বা যুগপ্রবর্তক সাংবাদিক হিসেবে। জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার, বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা এবং সর্বোপরি তাদের গৌরবজনক ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন করে একটি নিয়মতান্ত্রিক ধারায় তাদেরকে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামমুখর করে তোলার জন্য তিনি সেদিন অকুতোভয়ে সাংবাদিক নিষ্ঠার যে প্রমাণ রেখেছেন, তার কোনো তুলনা আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাসে নেই। এ ক্ষেত্রে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার নামটিও এসে যায় অনিরুদ্ধভাবেই। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাংলাবাদী রাজনীতির ধারাবাহিকতায় মানিক-মুজিব-সিরাজ মানুষকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্র থেকে আর তারই পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়ে ওঠে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সঠিক চিত্র তুলে ধরে আন্দোলনকে বেগবতীরূপ প্রদানে সহায়তা, চুয়ান্নর নির্বাচনে হক-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী তথা যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে সুনিশ্চিত করা, আইয়ুবের মার্শাল ল’য়ের বিরুদ্ধে বুদ্ধিদীপ্ত ও অসম সাহসিকতাপূর্ণ সাংবাদিক দ্বৈরথ, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, চৌষট্টির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে ‘পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’ শীর্ষক নির্দেশনা প্রদান, পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের অসারতা প্রমাণ, পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্য ও বিমাতাসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা, বঙ্গবন্ধুকে এ দেশের একমেবাদ্বিতীয়ম নেতারূপে প্রতিষ্ঠিত করা আর ছয় দফাকে জনগণের প্রাণের দাবিতে পরিণত করার ক্ষেত্রে সিরাজুদ্দীন হোসেনের অবদান আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাসের পাতায় পাতায় মনি-মুক্তারূপে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে রয়েছে। ধর্মান্ধ গণবিরোধী অপশক্তির মুখোশ তিনি বারবার উন্মোচন করে গেছেন একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয়তাভিত্তিক দেশ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে। সত্তরের নির্বাচন আর একাত্তরে ইয়াহিয়ার জিন্দানখানায় বসে নির্ভীক সাংবাদিকতার যে নিদর্শন তিনি রেখে গেছেন, তা নির্মেঘ আকাশের শুভ্র জ্যোতিষ্কসম সদা সমুজ্জল!