মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করেছেন দেড় হাজার বছর আগে। তিনি মহাকাল অবধি সকলের অনুসরণীয়। তাঁকে ভালোবাসা ঈমানের দাবি, তাঁকে জানা অপরিহার্য। অথচ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের কাছে তিনি যেন অজানাই থেকে যাচ্ছেন। এর একটি কারণ হতে পারে, অহেতুক দীর্ঘ রচনা। যা তাদের পাঠে অধৈর্য করে দেয়, আবেগকে অসুখী করে তোলে। তাদের জন্য, আমাদের সকলের জন্য এ-অস্থির সময়ে বিদগ্ধ লেখক মাওলানা জুবাইর আহমদ আশরাফ সুবিশাল ইতিহাস সংক্ষেপে সহজে বলার চেষ্টা করেছেন। এক নিঃশ্বাসে পড়ে মরমে মস্তিষ্কে গেঁথে রাখার মতো করে লিখেছেন। নামও দিয়েছেন ‘সংক্ষিপ্ত সীরাত’। সংক্ষিপ্ত বলা হলেও এটি শুধু জীবনপঞ্জি বা ধারাবিবরণী নয়। বরং একাডেমিক ধাঁচে লেখা একটি নাতিদীর্ঘ নবীজীবনী। দুইভাবে জীবনীকে সাজানো হয়েছে—সারসংক্ষেপ করে এনেছেন শেষের অংশে, নিবন্ধ আকারে এনেছেন প্রথম অংশে। তবে রিপিট নয়। এ-এক অদ্ভুৎ অনিন্দ্য সুন্দর বিন্যাস। শেষের সারটুকু তিনি মাত্র ৩০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, সেটি ক্লাসিক্যাল বাংলা সীরাত সাহিত্যের একটি দীপ্তিময় পাঠের আনন্দ দেয়। ভাবে, কবিতায়, সুখে, স্বাচ্ছন্দ্যে দুলতে দুলতে সীরাত সরোবরের একটি দরোজা ধরে এগিয়ে যাওয়া যায় ‘নিভে যাওয়া সেই দিনের দীপালি’ মুখে। প্রথম অংশে উনিশটি গবেষণালব্ধ নিবন্ধে ভাগ করে তিনি নবীজির আগমন-সুসংবাদের পথ ধরে বিদায়কাল পর্যন্ত চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন—সময়ক্রম, টেক্সট, উদ্ধৃতি ও তথ্যসূত্র সহকারে। বংশ জন্ম পরিবার, জীবন যৌবন সফর, মেরাজ হিজরত হজ, গৃহ সমাজ ভাষণ, এমনকি জুমা মোজেযা দর্শন—কিছুই বাদ যায় নি। প্রশ্ন হলো, এত ছোট্ট পরিসরে তা কী করে সম্ভব হলো? এই বিস্ময়-রহস্যের উন্মোচন হতে পারে কেবল বইটি পাঠের মধ্য দিয়েই। যাকে বলা যায়, বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু। লেখকের এই ছোট্ট বইটি সম্ভবত একটি সুপরিসর সীরাতগ্রন্থের খসড়া। যা অস্থিরমতি তরুণদের জন্য অযুত ঢাউস সাইজের সীরাতগ্রন্থ পাঠের কষ্টলাঘবের উপায়ও বটে। একটি সুখী সমৃদ্ধ সীরাতের বই ‘সংক্ষিপ্ত সীরাত’। লেখককে অভিনন্দন, পাঠককে আমন্ত্রণ।
জুবাইর আহমদ আশরাফ স্বভাবগতভাবেই পাঠপ্রিয়, সন্ধানী মানুষ। তাঁর ভাষা সহজ নিটোল। বড় আলেমের যােগ্য সন্তান। যারা পড়েন অনেক, লেখেন সামান্য, তিনি ওই গােত্রের লেখক। ধীমান, বুদ্ধিচঞ্চল, সরলচিন্তক এই আলেম লেখক জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭০ সালে। তার কীর্তিমান বাবা শাইখুল হাদীস মাওলানা আশরাফ উদ্দীন আহমদ রহ. ছিলেন ভারত-স্বাধীনতাআন্দোলনের বীর সিপাহসালার শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর বিশিষ্ট ছাত্র। পরিচ্ছন্ন বােধ, আদর্শিক চেতনা আর জ্ঞানতপস্যা পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। বিরলপ্রজ মনীষী মুহাদ্দিস আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.-এর সান্নিধ্য ওই বােধ চিন্তা ও আদর্শের দীপ্তিকে করেছে আরও দীপান্বিত। ১৯৯১-৯২ সালে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেছেন জননীবিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে। কর্মজীবনের প্রায় শুরু থেকেই হাদীসের অধ্যাপক। লেখকজীবনে তার অনন্য স্বাতন্ত্র্য হলাে তিনি দীর্ঘদিন ভাষাবিজ্ঞানী ড. কাজী দীন মুহম্মদের অধীনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেছেন। তার সযত্ন পাঠ, তীক্ষ্ণ আহরণ ও সৃজনশীল মেধায় মুগ্ধ ছিলেন কাজী দীন মুহম্মদ রহ.। তিনি ভাষার সমঝদার। তার লেখা প্রাঞ্জল । দুধের সরের মতন স্বাদু ও ভােরের হাওয়ার মতন কোমল।