রুদ্ধশ্বাস সপ্তক গল্পের শেষে চকিত মোড় ঘোরানো --- যাকে বলে চমকান্ত, নাটকীয় পরিণতি, ইংরাজিতে কেউ কেউ বলেছেন whip-crack end. এটা এক সূক্ষ্ম শিল্প। একেবারে নিক্তি মেপে চমকের রসায়নটি মেশাতে হয় আখ্যানের কাঠামোতে। বড় মুন্সিয়ানার কাজ। যদি মাঝপথে ধরা পড়ে যান দুর্বল কথক, কিংবা যদি শেষ তুলির টানটি দিতে একটু মোটা আঁচড় লেগে যায় --- বিস্বাদরসে ভরে যায় পাঠকের জিভ। সাতটি গল্পের এই সংকলন। অভাবিত অন্তিম চমক ছাড়াও আর একটি common element আছে অনেকগুলি গল্পে--- অতিলৌকিককে এক থাপ্পড়ে ভেঙে দিয়ে লৌকিকতার মাটিতে আছড়ে ফেলা। প্রতিটি কাহিনিই আনকোরা নতুন। প্লটের পুনরাবৃত্তি নেই কোথাও। ‘ননিগোপাল’ চরিত্রটি দু-দুবার এসেছে বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা পটভূমিকায়--- একবার গালুডি’র হাড়-হিম-করা ভূতুড়ে আবহে (‘ননিগোপালের ভয়’), অন্যবার এই কলকাতাতেই, এক চমকপ্রদ co-incidenceএ ভরপুর সিরিওকমিক পরিস্থিতির মধ্যে (‘ননিগোপালের জুতো’)। ‘হাতে রইল তিন’ গল্পে জ্যোতিষী কিঙ্কর রায়ের মর্মান্তিক ভবিষ্যবাণীর আসল রহস্য উদঘাটনের ধাক্কা আমাদের বোবা করে দেয়। ‘অ্যাটিনা’ গল্পে মৃত অ্যালসেশিয়ানকে ঘিরে শিরশিরে রহস্যজাল আমাদের লোম খাড়া করে। ‘মেঘবরণ’ আখ্যানে সমাপতন আর মোচড়ের বিস্ময়কে ছাপিয়ে যায় এক বিধুর হাহাকার। প্রেম-অপ্রেমের, আঘাত-প্রত্যাঘাতের সুতীব্র রসায়ন জটিল মনস্তাত্ত্বিক রূপ নিয়েছে সাঁতার-ক্লাসের প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা গল্প ‘জলযাপনের দিনগুলি’তে। সংকলনের সেরা গল্প ‘অতঃ সার শূন্য’তে সন্দেহপ্রবণ স্বামী ও সুন্দরী স্ত্রী’র সম্পর্কের এক অভাবনীয় টানাপড়েন ও চূড়ান্ত পরিণাম, ধাপে-ধাপে, পাঠকের উৎকন্ঠা নিয়ে খেলতে খেলতে উন্মোচিত হয়। অবিশ্বাস্যকে বিশ্বাস্য করে তোলার এই নমুনাটি willing suspense of disbelief এর শিখর ছুঁয়েছে। প্রসেনজিতের পূর্ববর্তী গল্প-সংকলন (‘রস রহস্যের সাতকাহন’) ও এই বর্তমান গ্রন্থটি মিলিয়ে পড়লে সন্দেহ থাকে না যে, শক্তিমান এক গদ্যকার ইতোমধ্যেই নিজের পা দুটি সবলে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন বাংলা গল্পের ময়দানে। একটু বাড়াবাড়ি শোনালেও কথাটা বলা জরুরি যে, এঁর ঘরানাটি সত্যজিৎ-ঘরানার আত্মীয়।