"কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ কবি নামে উপন্যাস লেখা হয়েছে বাঙলা ভাষায়, কিন্তু প্রকৃত কবি নিয়ে কোনাে উপন্যাস লেখা হয় নি; ওগুলাে লেখা কবিয়ালদের নিয়ে। হুমায়ুন আজাদের কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ-এর নায়ক কবি, প্রকৃত কবি, আধুনিক কবি, যার নাম হাসান রশিদ। একজন আধুনিক কবির জীবন কেমন? কোন স্বপ্ন কল্পনা আবেগ আনন্দ অসুখ তাকে বাঁচিয়ে রাখে, আর স্বাদ দেয় অন্ধকার মৃত্যুর? জীবনের সাথে সে সম্পর্কিত এবং অসম্পর্কিত কতােখানি? জীবন কি তার কাছে বহুব্যবহৃত নােংরা পােশাক, যা সে অনায়াসে দান করে দিতে পারে ভৃত্যদের? জীবনে কি সবচেয়ে ভালাে একেবারে না জন্মাননা, এবং দ্বিতীয় ভালাে যৌবনেই মৃত্যুকে বরণ করা? একজন আধুনিক কবি কতােখানি পুরুষ, কতােখানি অপুরুষ? কতােখানি দণ্ডিত সে? কবি হাসান রশিদ কৈশাের পেরিয়ে ধীরেধীরে কবিতার দিকে এগিয়ে গেছে, শিল্পকলার জন্য অস্বীকার করেছে ঘৃণ্য অশীল জীবনকে, আবার গভীর বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরে রাখতে চেয়েছে নষ্টভ্রষ্ট পঙ্কিল দূষিত জীবনের সুন্দর মুখ। হাসান রশিদ ইলশে মাছ লাউডগা পেঁয়াজ ধনেপাতার জীবন, বেছে না নিয়ে নিয়েছে শিল্পকলার অসম্ভব জীবন যেখানে আছে শুধু সৌন্দর্য, নিরন্তর আলােড়ন বিষের মতাে অমৃত; শিল্পকলার প্রতিদ্বন্দ্বী হিংস্র জীবন হাসান রশিদের ওপর চরিতার্থ করেছে তার চরম প্রতিহিংসা, তাকে করে তুলেছে অপুরুষ। হাসান রশিদ অবশেষে মুখােমুখি হয়েছে এমন এক জীবনের, যা মৃত্যুর থেকেও নির্মম, ট্র্যাজেডির থেকেও হাহাকারপূর্ণ। আধুনিক কবির অন্তর্লোক ও বস্তুজগতের প্রত্যক্ষ বিবরণ দিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ, যিনি নিজে, কবি; এবং চিত্রিত করেছেন এক ভয়াবহ জগত। এক অতুলনীয় যন্ত্রণার কবিতা ও উপন্যাস কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ।
প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত অভীষ্ট এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার মাধ্যমে ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারের বিরুদ্ধে কলম তুলে নিয়ে বিশেষভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক এই লেখক একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, গবেষক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, ভাষাবিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক। বাবা-মায়ের বড় সন্তান হুমায়ুন আজাদ ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে রাঢ়িখাল গ্রামে, যার কথা পরবর্তীতে তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে উঠে এসেছে। ম্যাট্রিকুলেশন ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমূহ নারীবাদকে তুলে ধরেছে ও ধর্মীয় মৌলবাদের প্রবল বিরোধিতা করেছে, যার ফলে তিনি একশ্রেণীর মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই এর মধ্যে 'পাক সার জমিন সাদ বাদ', 'সব কিছু ভেঙে পড়ে', 'ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল' ইত্যাদি উপন্যাস ও 'অলৌকিক স্টিমার', 'জ্বলো চিতাবাঘ', 'কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু' ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'নারী' প্রবন্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা একসময় নিষিদ্ধ হয়েছিল এই দেশে। প্রতিভাবান এই সাহিত্যিক ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক' সহ আরো অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন হুমায়ুন আজাদ।