"রাজনীতিবিদগণ" বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ পৃথিবী চালাচ্ছেন যে-শক্তিমান রাজপুরুষেরা, তাঁদের সুভাষিত নাম রাজনীতিবিদ। রাজারা নেই, তবে পুরােনাে রাজাদের সিংহাসন দখল করেছেন। এই নতুন রাজারা, যারা জনগণের কল্যাণ ও সেবার জন্যে ঘুমােতে কষ্ট পান, সাধারণ মানুষের জন্যে যাদের প্রেমের কোনাে শেষ নেই । কিন্তু এই রাজাদের দিকে তাকালে দেখতে পাই তাদের। কলঙ্কিত মুখ; এমন কোনাে পাপ নেই, যাতে তাঁদের মুখমণ্ডল শােভিত নয়। ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থলুণ্ঠন, হত্যাকাণ্ড, প্রতারণা, লাম্পট্য, কপটতা ও আরাে যতাে সৌন্দর্য মানুষের পক্ষে অর্জন সম্ভব, তার সবগুলােই তাদের অর্জনে; কিন্তু তাঁরা ন্যায়, কল্যাণ, উন্নতি, অধিকার, গণতন্ত্র, দেশপ্রেম প্রভৃতি কপট শ্লোগানে মুখর। বাঙলাদেশের রাজনীতিলােকটি খুবই দূষিত; এখানে বুট পরে একের পর এক এসেছে সামরিক স্বৈরাচারী, এক সময় গণরােষে বা সুবিধামতাে পােশাক বদলে হয়েছে গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ, আর যারা করেন দলীয় রাজনীতি, তাঁরাও একই স্বভাবের; ক্ষমতা ও অর্থলুণ্ঠন ছাড়া আর কোনাে লক্ষ্য নেই বাঙলাদেশের রাজনীতিলােকে। এটি পরিণত হয়েছে পুরােপুরি দূষিত এলাকায়, বিপর্যস্ত হচ্ছে দেশ, পীড়িত অসহায় হয়ে উঠছে জনগণ। বাঙলাদেশ হয়ে উঠছে পার্থিব নরক। বাঙলাদেশের রাজনীতিক পরিস্থিতি নিয়ে এই অভিনব উপন্যাসটি লিখেছেন হুমায়ুন আজাদ, সত্য প্রকাশে যিনি সব সময়ই সুদৃঢ়। হুমায়ুন আজাদ প্রয়ােগ করেছেন এমন এক ভাষা, যা তাঁর নিজের ভাষা নয়, ওই ভাষাও রাজনীতির মতােই দূষিত-চলতি, সাধু, আঞ্চলিক, ইংরেজির এক অসহনীয় মিশ্রণ । উপন্যাসে কথা বলেছে জনগণ, লেখক নন, তাদের মুখের ভাষায় হুমায়ুন আজাদ চিত্রিত করেছেন দেশের ভয়াবহ রাজনীতিক বাস্তবতা, বর্ণনা বিবরণ ব্যঙ্গপরিহাস রূপক প্রতীক উপাখ্যানে যা অতুলনীয়।
প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত অভীষ্ট এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার মাধ্যমে ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারের বিরুদ্ধে কলম তুলে নিয়ে বিশেষভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক এই লেখক একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, গবেষক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, ভাষাবিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক। বাবা-মায়ের বড় সন্তান হুমায়ুন আজাদ ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে রাঢ়িখাল গ্রামে, যার কথা পরবর্তীতে তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে উঠে এসেছে। ম্যাট্রিকুলেশন ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমূহ নারীবাদকে তুলে ধরেছে ও ধর্মীয় মৌলবাদের প্রবল বিরোধিতা করেছে, যার ফলে তিনি একশ্রেণীর মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই এর মধ্যে 'পাক সার জমিন সাদ বাদ', 'সব কিছু ভেঙে পড়ে', 'ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল' ইত্যাদি উপন্যাস ও 'অলৌকিক স্টিমার', 'জ্বলো চিতাবাঘ', 'কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু' ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'নারী' প্রবন্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা একসময় নিষিদ্ধ হয়েছিল এই দেশে। প্রতিভাবান এই সাহিত্যিক ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক' সহ আরো অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন হুমায়ুন আজাদ।