রাসূলুল্লাহ সা.-এর জীবনেই রয়েছে আমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। তাই সিরাত আমাদের পাথেয়। প্রত্যেক মানুষের জন্যই সিরাতে রাসূলে রয়েছে জীবনের নির্দেশিকা। তবে দাঈদের জন্য এই নির্দেশিকা আরও বেশি বিশেষ বৈকি! সিরাতের আলো দাঈর পথচলার সার্বক্ষণিক অবলম্বন। . কোনো জনপদে আপনি দাওয়াতি কাজ করছেন, যেখানে আপনাকে প্রতিটি কদম ফেলতে হচ্ছে সন্তর্পণে— নবিজির নবুওয়তি জীবনের প্রথম তিনটি বছরের মতো। দারুল আরকামের সংগোপন তালিমগাহের মতোই আপনারা জড়ো হচ্ছেন এ সময়ের কোনো দারুল আরকামে। কিংবা দাওয়াতি ময়দানে প্রত্যাখ্যাত হয়ে, হেনস্থা হয়ে ফেরার পথে তায়েফের রক্তরঞ্জিত মানুষটিকে আপনি যেভাবে অনুভব করবেন, সেভাবে আর কেউ পারবে কি? তাই সিরাতের হৃদয়ানুভব একজন দাঈর চেয়ে বেশি আর কার হতে পারে! . অথবা কারান্তরিন মজলুম দাঈর চেয়ে কে বেশি অনুভব করতে পারবে শেবে আবু তালিবের হৃদয়বিদারক দিনগুলো? বদর, উহুদ, খন্দক, হুদায়বিয়াকে কালের মোটা পর্দার ওপাশে সেই তো সবচে স্বচ্ছভাবে দেখতে পাবে, যে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার ময়দানে সক্রিয়! . সিরাতের ঘটনাবলির বিস্তারিত বিবরণ ও বিশ্লেষণের চেয়ে সর্বজনবিদিত ঘটনাবলি উল্লেখ করে এর থেকে ইসলামের কর্মীদের পাথেয় সন্ধান করেছেন উসতায মুসতফা আস-সিবাঈ। তিনি খুঁজে ফিরেছেন একজন দাঈ কীভাবে নবিজীবনের শিক্ষাকে ময়দানে কাজে লাগাবেন, সেই রসদ। নিছক তথ্য ও তত্ত্বাবলি উপস্থাপনের চেয়ে তিনি প্রাধান্য দিতে চেয়েছেন, দাওয়াতের কর্মীর জীবন ও পথচলায় সিরাতের প্রয়োগকে। অতএব, উসতায মুসতফা আস-সিবাঈ রচিত এ সিরাতকে বলা যায়— দাঈর জন্য সিরাত; আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে বুলন্দ করার পথে আত্মনিবেদিত কর্মীর জন্য সিরাত।
ড. মুসতফা সিবায়ী রহিমাহুল্লাহ— ইলমি অঙ্গনে এক সুবিদিত নাম। কুরআন-সুন্নাহ-সিরাত এবং ইতিহাসের মিশেলে তৈরি করতেন তার অনবদ্য সব প্রবন্ধ-গবেষণা পত্র এবং গ্রন্থ। তার প্রতিটি রচনায় উপচে পড়তো উম্মাহর প্রতি দরদভরা জাগরণী সুর এবং মিথ্যাপন্থি যারা, বিশেষ করে প্রাচ্যবাদী, তাদের বিরুদ্ধে তার বয়ান-বক্তৃতা-রচনাসম্ভার যেন ছিলো কোনো অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়গিরি, যার তেজোদ্দীপ্ত লাভার উত্তাপে ছারখার-প্রায় হয়ে পড়তো মিথ্যার সমস্ত প্রাসাদ-চূড়া৷ রচনার ওজস্বিতা এবং বাচনিক নান্দিকতা তাকে এনে দিয়েছিলো 'ঊনবিংশ শতাব্দীর আসকালানির মতো বিরল সম্মানীয় উপাধি৷ উম্মাহর মাঝে ঐক্য স্থাপন, বিশ্বব্যাপী তাদের সম্মিলিত জাগরণ এবং ভ্রান্ত মতবাদ ও চিন্তার অবদমনে লিখে গেছেন মৃত্যুর ফেরেশতা এসে সমুখে দাঁড়ানোর পূর্ব অবধি৷ চিন্তা ও আকিদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কোনো স্যাক্রিফাইসের ধার ধারতেন না৷ আকিদার শুদ্ধতার জায়গায় ছিলেন আপসহীন। শিয়াদের ভ্রান্ত চিন্তা-দর্শনের প্রতিবাদ করেছেন শক্তহাতে৷ অবিরাম কলম চালিয়েছেন তাদের বিভ্রাটপূর্ণ মতাদর্শের ধ্বংস সাধনে৷ মিশর জামিয়াতুল আযহারে যখন প্রাচ্যবিদদের প্রভাব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, মহামারির মতো বিস্তার ঘটতে থাকে তাদের প্রতি মানুষের মুগ্ধতা, আকাশে-বাতাসে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে যখন প্রাচ্যবিদদের বয়ান-ভাষণ ও রচনার উদ্ধৃতি তখন তিনি উদ্যোগী হয়ে সবার চোখে আঙুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দিলেন ওরিয়েন্টালিস্টদের তাবৎ জালিয়াতি। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ার বিখ্যাত শহর হিমসে জন্মগ্রহণ করেন৷ শত বছর ধরে হিমস নগরীর দাওয়াহ ও দীনী বয়ান-বক্তৃতার দায়িত্বে ব্রত ছিলো যে পরিবারটি সেই পরিবারেই জন্ম আল্লামা মুসতফা সিবায়ীর৷ বলার অপেক্ষা রাখে না— পরিবারটি ছিলো জ্ঞান ও ইলমের উজ্জ্বল আলোক বিভায় ভাস্বর৷ পরিবারেই, বাবার কাছেই তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি৷ তার রচনা ও ভাষণের যে প্রাঞ্জলতা পরবর্তী সময়ে সিরিয়ার তরুণ-যুবা ও বয়োবৃদ্ধদের মুগ্ধ করে তুলেছিলো বোধ করি তার উৎস পিতারই প্রাথমিক বিদ্যানিকেতন৷ তার পিতারও বিশেষ খ্যাতি ছিল প্রাঞ্জল ও সদালাপী বক্তা হিসাবে৷ পারিবারিক বিদ্যানিকেতনের বাইরে তার প্রথম শিক্ষালয় জামিয়াতুল আযহার। ১৯৩১ সালে তিনি আযহারের উদ্দেশে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। আযহারে পড়াকালীন নানান শাস্ত্রের প্রতি তিনি অনুরাগী হয়ে ওঠেন। এবং নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচির বাইরেও তার পাঠ চলতে থাকে নানামাত্রিক বিষয়ে। আযহারে পড়াকালীনই তিনি শাইখ হাসানুল বান্না রহিমাহুল্লাহর মতাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। এবং তার আদর্শ সামনে রেখে জ্বলে ওঠেন ইটালিয়ান আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলনে। ফলস্বরূপ তাকে পুলিশের হাতে বন্দি হতে হয়৷ ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে মিশর সরকার তাকেসহ অন্যান্য বন্দিকে কারাগারে পাঠায়। তিন মাস মিশরে, চার মাস ফিলিস্তিনে এভাবে সাত মাস তাকে বন্দি জীবন কাটাতে হয়। সাত মাস কারাবরণের পর মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলবার অবকাশ পান৷ দেশে ফিরে আরও পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলেন 'ইখওয়ানুল মুসলিমিন'-এর সিরিয়া শাখা। এক সময় রাজনৈতিক অঙ্গনেও তিনি সাফল্যের প্রমাণ রাখেন। বিপুল জনসমর্থন পেয়ে সংসদসদস্য নির্বাচিত হন৷ কিন্তু সাংসদ হওয়ার পরও সত্য উচ্চারণের অপরাধে (!) দ্বিতীয়বারের মতন তাকে নবী ইউসুফের পাঠশালায় যেতে হয়৷ এবারে তাকে নির্বাসিত করা হয় লিবিয়াতে৷ সিরিয়াকে তিনি অনেক দিয়েছেন৷ বিশেষ করে তিনি যখন মন্ত্রি তখন সিরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন৷ ইসলামি শিক্ষাকে পৌঁছে দেন অনন্য উচ্চতায়৷ সাংবাদিকতাও করেন অনেকদিন৷ ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৮– এই সময়কালে তার সম্পাদনায় চারটি পত্রিকা আলোর মুখ দেখে৷ এ ছাড়া তার প্রকাশিত গ্রন্থাবলির সংখ্যা ২৮ ছাড়িয়েছে। বয়ান-রচনা-সংগ্রাম— প্রতিটি ক্ষেত্রেই আল্লামা মুসতফা সিবায়ী রহিমাহুল্লাহ ছিলেন এক প্রোজ্জ্বল বাতিঘর৷ পথ দেখিয়ে গেছেন অজস্র পথহারা মানুষকে। ভীষণ আত্মপ্রত্যয়ী, উম্মাহর জন্য দরদি দীর্ঘ সংগ্রামমুখর জীবন কাটিয়ে খ্রিস্ট ১৯৬৪ সালে দুনিয়ার যাত্রা শেষ করেন৷ বিপুল পাথেয় সাথে করে নতুন যাত্রা শুরু করেন অফুরান শান্তির এক আলয়ের পানে৷ আমরা তার জান্নাত-জীবনের বিপুলতর 'সমৃদ্ধি' কামনা করছি।