ভূমিকা গত শতকের পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকগুলিতে যেসব সাহিত্যপ্রেমী তাঁদের কিশোরবেলা কাটিয়ে এসেছেন, তাঁদের কাছে দুর্গাপুজোর অন্যতম আকর্ষণ ছিল দেব সাহিত্য কুটীরের পূজাবার্ষিকী। প্রতি বছর ভিন্ন ভিন্ন নামে এগুলি প্রকাশিত হত, যেমন, রাঙারাখী, নবপত্রিকা, নীহারিকা, মণিহার, আগমনী ইত্যাদি। বাংলার সমস্ত খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের লেখায় এই পূজাবার্ষিকীগুলি সমৃদ্ধ হত। এই সব পূজাবার্ষিকীগুলিতে বছরের পর বছর যেমন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর টেনিদা এবং তার তিন সঙ্গীকে নিয়ে, শিবরাম চক্রবর্তী তাঁর হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনকে নিয়ে পূজাবার্ষিকীর হাসির আসরটি মাতিয়েছেন, তেমনই পরবর্তীকালে রাজকুমার মৈত্র তাঁর সৃষ্ট বগলামামা এবং তাঁর নবরত্নকে নিয়ে সেই আসর আরও জমিয়ে তুলেছেন। রাজকুমার মৈত্র শুধুমাত্র বগলামামা এবং তাঁর সঙ্গীদের মজার কাহিনিতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নানা স্বাদের গল্প যেমন গোয়েন্দা কাহিনি, ভূতের গল্প, রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনি ইত্যাদিও তিনি কিশোরদের জন্য লিখেছেন। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট ‘বগলামামা' তাঁকে ছোটদের সাহিত্যে স্মরণীয় করে রেখেছে। বগলামামার আবির্ভাব ‘নব-রত্ন' গল্পটিতে। বগলামামা কাহিনি শুরুর সময়কাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগে। ঘটনাস্থল হাজারিবাগ জেলার বোকারো কোলফিল্ডের কারগালি কোলিয়ারি। বগলামামার সঙ্গী নয় কিশোর—দুই ভাই হাবু-কেবু, নাড়ু, ধনু, ঝান্টু, ফণী, নিমাই (ত্রিদিব), সাধন আর অরুণ। বগলামামা ছিলেন এদের ক্যাপ্টেন। হাবু, যার ভালো নাম অমল, তার লেখনীতেই বগলামামার সবকটি কাহিনি বিবৃত হয়েছে। বগলামামা ছিলেন কোলিয়ারিসুদ্ধু লোকের মামা, অর্থাৎ ছোট থেকে বড় সবাই তাঁকে বগলামামা নামেই ডাকত। তিনি ছিলেন এভার ব্যাচেলর। বগলামামার কাজ ছিল কোলিয়ারির ইয়ার্ডে, সেখানে কয়লা ভরতি মালগাড়িতে কুপন মারা অর্থাৎ কোন ঠিকানায় ওই কয়লা যাবে, সেই ঠিকানা লেখা কাগজ মারা। নিজের কাজ সম্বন্ধে বগলামামা গর্ব করে বলতেন, “কোলিয়ারির সেরা কাজ হচ্ছে আমার। ম্যানেজার, সুপারিনটেনডেন্ট, সার্ভেয়ার কেউ কিছু না। আমি যদি ঠিকমতো মালগাড়ি না পাঠাই তাহলে ব্যবসা করতে হবে না। দু-দিনেই কোলিয়ারি লাটে উঠে যাবে।” বগলামামার বর্ণনায় হাবু লিখছে—ভদ্রলোক লম্বায় চারফুট, বয়স চল্লিশের কোঠায়। নাদুসনুদুস চেহারা। নেয়াপাতি ভুঁড়িটায় খাকি হাফপ্যান্টটা যেন ঝুলছে কোনোরকমে। হাতগুলো বেঁটে বেঁটে। “তাঁর মুখখানা চাঁদের মতো গোল।” বগলামামার কোয়ার্টারটি ছিল নয় বন্ধু অর্থাৎ নবরত্নের ক্লাব কাম আড্ডাখানা—নাম ছিল বন্দেমাতরম ক্লাব। সেখানে বগলামামার উপস্থিতি থাক বা না থাক, তাঁর রান্নাঘরে ছিল ভাগনেদেরই একচ্ছত্র অধিকার, তেমনই তাঁর বাকি ঘরগুলি ছিল হাবু-কেবু, ধনু, ঝান্টুদের তাস-দাবা ক্যারম, আড্ডা মারার আসর।...