কবি জামাল হোসেনের কবিতা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো। আপাত শান্ত বুকে কান পাতলে ভিতরে প্রজ্বলিত অগ্নিস্রোতের গর্জন শোনা যায়। আঘাত ও অভিঘাতে তার কণ্ঠতন্ত্রী আন্দোলিত হলে যে কম্পন সৃষ্টি হয়, সেই কম্পন থেকেই কবির মসীগর্ভে প্রবাহিত হয় ঝড়। সেই ঝড়ে ফেনায়িত উর্মিমালা প্রবলবেগে আছড়ে পড়ে জীবনের বালুকাবেলায়। বিচূর্ণ হয় পাষাণের বুক। বিক্ষত হৃদয়ের গহিন থেকে তখন প্রবল কল্লোলের মতো উদগিরীত হয় কবিতা। মানুষ পৃথিবীর সীমারেখা পেরিয়ে চাঁদে পা রেখেছে। মঙ্গলের মাটি ছুঁয়েছে। আকাশে গৃহ নির্মাণ করেছে। মৃত্তিকা ভেদ করে পৃথিবীর অভ্যন্তরের তপ্ত শিলারাশি থেকে তুলে এনেছে ডাইনোসরের ফসিল, মণিমুক্তা হিরে জহরত। তা দিয়ে গড়ে উঠেছে গগনচুম্বি প্রাসাদ। পাতালে রচিত হয়েছে স্বর্ণখোচিত ঘর-বসতি। ধরিত্রী আজ মানুষের লীলাক্ষেত্র। ধরণীর ধূলি হতে অসীম আকাশ অবধি বিস্তৃত হয়েছে মানুষের সাম্রাজ্য। প্রকৃতিকে পরাভূত করে মানুষ আজ ধরণীর অধিপতি। অন্তহীন ক্ষমতার অধিকারী মানুষ। এই সকল দম্ভ বিচূর্ণ করে দিয়েছে করোনা। মানুষের মুখোশ খুলে মানুষ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার এখনই সময়। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এখনই সময়। করোনার অভিঘাতে উ™£ান্ত সময়ের ক্রূর বাস্তবতা কবির হৃদয়ে দাগ কেটেছে। নিবিড় অনুসন্ধিৎসা ও মানবিক নিরীক্ষণে কবিতার পরতে পরতে তাই ভাস্বর হয়েছে প্রেম ও বিরহের অনন্য পদাবলি। এই গন্থের কবিতাসমূহের শিকড় মাটিলগ্ন থেকেও পত্রপল্লবে সৃজিত হয়েছে বহুমাত্রিক বিকাশ। মাটির সোঁদাগন্ধ, নাড়ির টান, প্রকৃতির অপার সৌন্ধর্যমগ্নতা ইত্যাদি একটি মোহনায় মিলিত হয়ে রচনা করেছে এক অমর প্রেমের বিচ্ছেদগাথা। এই গ্রন্থের কবিতাগুচ্ছ এক অবরুদ্ধ সময়ের দলিল। আর এই রুদ্ধ দিনগুলোর করালগ্রাস ছাপিয়ে এক নতুন জীবনের স্বপ্নিল কারুবাসনাই এই কাব্যগ্রন্থের মর্মকথা। কবিতার আঙ্গিক ও স্টাইল দুটোই স্বনিয়ন্ত্রিত, সাবলীল ও অন্যের প্রভাবমুক্ত।
নিখাদ প্রেম ও বিরহ, প্রকৃতি ও লালিত্য, দ্রোহ ও দেশপ্রেম, স্মৃতি ও সমকাল যখন নিছক আত্মকথন নয় অনবদ্য নিজস্বতায় কাব্যশরীরে প্রতিবিম্বিত হয়, স্বতন্ত্র অভিব্যক্তির দ্যোতনা সৃষ্টি করে, তখন যে-কোনো সাহিত্যরসিক অনায়াসে বুঝে নেন, কোথায় এই কবির ঘর-বসতি। জামাল হোসেন একাধারে কবি ও চিত্রশিল্পী। পেশায় কূটনীতিক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ—বকপক্ষী ও সারমেয় ভ্রাতৃত্রয় (২০১৭), প্রেমময় পৃথিবীর জন্য (২০১৮), প্রণতি গ্রহণ করো (২০২২), একমুঠো পলিমাটি (২০২২), নীল লেফাফার চিঠি (২০২২)। তাঁর ‘বকপক্ষী ও সারমেয় ভ্রাতৃত্রয়' কাব্যগ্রন্থ অসমিয়া ভাষায় অনূদিত হয়েছে। জন্ম ১৯৭৩। গোপালগঞ্জের শুক্তাইল গ্রামে। কর্ম ও জীবনসূত্রে বিচরণ করেছেন নানা দেশে, নানা শহরে। স্মৃতির ক্যানভাসে অগণন ছবি। তবে যে ছবি নিরন্তর ভিড় করে কবির মননে তার নাম বাংলাদেশ। আর চিরকালীন বাংলার মায়াবী প্রতিচ্ছবি মধুমতির স্নিগ্ধ জলধারায় স্নাত এক রমণীয় পল্লি। এই ছবি তাঁকে প্রাণিত, ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করে কাব্য ও চিত্রশিল্পের যৌথ সৃজনে। বাংলার জনপদ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শৈশবস্মৃতি, ভালোবাসা, মুক্তিযুদ্ধের শাণিত চেতনা, প্রতিবাদ ও দ্রোহ, প্রেম ও বিরহ তাঁর কাব্যশরীরে মূর্ত ও বিমূর্ত নিবেদনে ভাস্বর। কোমল প্রেম ও প্রকৃতি, বিরহ ও নিসর্গের অন্তর্নিহিত অভ্রংলিহ আবেগ তাঁকে আচ্ছন্ন করে, মানবতার পীড়ন তাঁকে দগ্ধ করে। স্ত্রী আবিদা হোসেন। দুই পুত্র। জাহিন ও রুহিন