"নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় তদানীন্তন ভারতবর্ষ থেকে বর্তমান বাংলাদেশ- গত ১৫০ বছরের ইতিহাসে রোকেয়ার মতো বিরাট চরিত্র বিরল। বিদেশি, বিজাতি দ্বারা পরিবেষ্টিত ভারতবর্ষে শাসন শোষণে পিষ্ট জর্জরিত বদ্ধমূল সমাজে নারীর জীবন- জীবিকা ও অধিকার পিছিয়ে থাকার কারণ উদঘাটনে রোকেয়া আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
প্রখর বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধ আত্মস্থ করে তিনি গভীরভাবে বুঝতে চেষ্টা করেছেন- নারী সমাজের পক্ষে বিপক্ষে ইতিহাসের গতিমুখ কেমন ছিল? বাঙালি নারীর চিন্তার দাসত্ব সৃষ্টিতে ভারতবর্ষে বিজ্ঞানের অনগ্রসর চিন্তা কতটুকু দায়ী? এই প্রশ্নগুলো রোকেয়াকে গভীরভাবে ভাবিয়েছে।
নারী সমাজের দুর্বিষহ জীবন, শত কণ্টকাকীর্ণ পথ,অবর্ণনীয় দুর্গতি,আর্থিক বৈষম্য, পুরুষতান্ত্রিক জীবনবোধের উপর নির্ভরশীল অক্ষম জীবনকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন। বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, শিল্প ও সাহিত্যকে পাথেয় করে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে গভীর যুক্তিবোধ দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছেন মানুষের উন্নত জীবন সংস্কৃতি, নীতি নৈতিকতা ও মর্যাদাবোধ। প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, আদর্শকে কঠোর কষাঘাতে জর্জরিত করে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ জীবন সংগ্রাম কীভাবে পরিচালনা করতে হয় তারই ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন রোকেয়া। একুশ শতকে আজ নারী অবরোধ বাসিনী নয়।
গত ১৫০ বছরে আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার অনেক উত্থান পতন হয়েছে। নারীর জীবন ও জীবিকার পরিসর বিস্তৃত হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে নারী সমাজের আমূল পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু হাজারো নিশ্ছিদ্র, বৈষম্য, অসংগতি, অনাচার, অবিচার, অসহিষ্ণুতা রাষ্ট্রিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উপাদান হিসেবে এখনো বিরাজ করছে। কিন্তু বাঙালি নারীর জীবন ব্যবস্থা পরিবর্তনে রোকেয়ার ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়।
একজন সাহিত্যিক, শিল্পী কিংবা দার্শনিকের বিশ্লেষণ কতটুকু কার্যকর তা নির্ভর করে শতবছর পেরিয়ে আজকের আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের যুগে সেই পর্যালোচনাটি জনপরিসরের মানসপট উন্নয়নে কতটুকু ভূমিকা রাখছে তার উপর। সাম্প্রতিক সময়ে নারীর উপর নির্যাতন, ঘরে-বাহিরে আর্থিক বৈষম্য, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে নারীর উপর অপমান, সহিংসতা, লাঞ্চনা যখন যথেচ্ছা চলছে তখন রোকেয়ার জীবন সংগ্রাম, তাঁর ইতিহাস ও বিজ্ঞান ভাবনা পর্যালোচনার গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।মনে হয় যেন রোকেয়া পেছন থেকে প্রশ্ন করছেন; আজকের নারী সমাজ কতদূর এগিয়েছে? উত্তরটি দিতে আমাদের হাজারো সংশয় কাজ করে।
আমরা এগিয়েছি বটে, কিন্তু অজস্র অসংগতি ও সামাজিক বৈষম্যকে অনুষঙ্গ করে এগিয়েছি। পুরুষ শাসিত বাঙালি নারী সমাজ এখনো তার আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। রোকেয়া যুগের সীমাবদ্ধতা আমরা এখনো পুরোপুরি অতিক্রম করতে পারিনি। নারীর স্বাধীন আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজিয়া আফরিন লিখেছেন রোকেয়ার ইতিহাসবোধ ও বিজ্ঞান ভাবনা বইটি। আকর্ষনীয় শব্দ ও গতিশীল ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে লেখক রোকেয়া সম্পর্কে নতুন করে চিন্তার পথ তৈরি করেছেন।
সমাজ পরিবর্তনে গত ১৫০ বছর আগের একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমাজকর্মীর ইতিহাস ও বিজ্ঞান ভাবনা কেন গুরুত্বপূর্ণ তার একটি দার্শনিক পর্যালোচনা বইটির মাধ্যমে পাঠক মানসে নতুন বার্তা দিতে পারে। রোকেয়ার প্রবন্ধ রচনা, সাহিত্য, উপন্যাসের কোথায় কোথায় ইতিহাস সচেতনতা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তা খুঁজে বের করার কষ্টসাধ্য কাজটি লেখক ঐকান্তিক প্রচেষ্টার সাথে করেছেন।বইটিতে লেখকের দার্শনিক পর্যালোচনা চিত্তাকর্ষক। লেখক দেখাতে চেয়েছেন, রোকেয়া তাঁর সমসাময়িক এবং তারও পেছনে রেখে আসা বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস প্রবক্তাদের উদ্ভাবন সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে জানতেন যা যুগের তুলনায় তাঁকেএগিয়ে রেখেছিল। বাঙালি সমাজে নারী বৈষম্য যে শ্রেণী বৈষম্যের অনুষঙ্গ উপাদান তাও তাঁর অজানা ছিল না।
অসম্ভব সুন্দর নির্লোভ সাধনায় রোকেয়ার দর্শন মানসপট লেখকের লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে। সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা জনপরিসরের জীবনবোধে কীভাবে শিল্প- সাহিত্য, সংস্কৃতি,বিজ্ঞান, দর্শন ও ইতিহাসবোধ নির্ধারণ করে দেয় তারও অসাধারণ ব্যাখ্যা বইটিতে রয়েছে। রোকেয়ার চিন্তা ও সাহিত্যকর্মে ইতিহাস বোধ ও বিজ্ঞান ভাবনা কীভাবে লুকিয়ে আছে তা লেখকের লেখনীর মাধ্যমে জানতে পেরে প্রকাশক হিসেবে আমি পাঠক সমাজের জন্য বইটি প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। রোকেয়ার সম্পর্কে খুব কম আলোচিত ও বিশিষ্ট দুটি দিক তথা তাঁর ইতিহাস ও বিজ্ঞান ভাবনা বিষয়ক বইটি প্রকাশ করার সম্মতি পেয়ে বন্ধু প্রতিম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজিয়া আফরিনের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।"