আমাদের দাদুবাড়ির গ্রামের নামটা অসাধারণ। কেমন এক গর্বমাখা নাম বীরের মাটি। শুনেছি কেউ কেউ বলে বীরের বাটি। কোনটা যে আদি নাম আর কোনটা লোকমুখে চলতে চলতে অধিক চালু হয়ে গেছে, সে তথ্যও আমার ঠিকমতো জানা নেই। তবে আমার কাছে বীরের মাটিই বেশি ভালো লাগে। কেউ বললে তখন শুনেও আরাম পাই, আবার নিজেও উচ্চারণ করে আনন্দ পাই।
আসলে দাদুবাড়ির স্মৃতি বলতে আমাদের সঞ্চয় কিছুই তেমন নেই। কেবল ওই গ্রামনামটুকু নিয়েই যা অহংকার। হ্যাঁ, তাই। কারো কাছে উদ্ধতভঙ্গিতে সে কথা বলি আর না-ই বলি, এ নাড়াচাড়া করেও আনন্দ পাই। নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে নিজেই প্রশ্ন করি:
এই ছেলে, তোমার বাড়ি কোথায়?
বাড়ি?
আমার কণ্ঠে কোনো দ্বিধা থাকে না, জড়তা থাকে না, স্পষ্ট ঘোষণা করি, বীরের মাটি।
এরপর কে যে আমার বুকের কবাট ধরে নাড়া দেয় জানি না। খুব সংগোপনে কে যেন জানতে চায়,
তুমি চেনো সেই গ্রাম?
সহসা আমার মুখে উত্তর যোগায় না। দূর শৈশবে দু’একবার গিয়েছি বটে সেই বীরের মাটি, কিন্তু তাকে কি চেনা বলে!
দূরপাল্লার বাস থেকে নেমে মায়ের কোলে চেপে গরুগাড়িতে উঠে বসা। তখন মেহেরপুর শহরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ওইরকমই ছিল। গরুগাড়ি কিংবা ঘোড়াগাড়িতে হেলতে দুলতে যেতে হতো বীরের মাটি। ছইতোলা গাড়ি। ছইয়ের সামনে পেছনে কাপড় টাঙিয়ে ঘেরা খাঁচা বানানো। সেই খাঁচার ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে যে সামান্য দেখা, তাকে কি চেনা বলে?
মনের মধ্যে আবারও প্রশ্ন ওঠ! চেনো তোমার পিতৃগ্রাম?
কী যে হয়, আমার গলা ধরে আসে। কথা বেরোয় না। এ সময় আমি গলা ঝেড়ে বলতেই পারি না, চিনি অথবা চিনি না। কুয়াশাঢাকা দূরের গ্রাম যেমন আবছায়া দেখা যায়, আমরা চেনা সেইরকম অস্পষ্ট। অথচ আমি দিব্যি মনে করতে পারি সংস্কারবিহীন প্রাচীন এক দোতলা দালান, শ্যাওলার আচ্ছাদন ঠেলে লাল ইটসুরকি দাঁত মেলে হাসছে হি হি করে। সেই দালানের পেছনে শান বাঁধানো পুকুর। শাপলা ফুলে আলো জ্বেলে রাখে সারা দিনরাত। এতেই কি আর পুরো গ্রাম চেনা হয়!
নিজেকেই বুঝিয়ে উঠতে পারি না। তাই চুপ করে থাকি। সত্যিকারের ঘটনা হচ্ছে, দাদুবাড়ি আমাদের যাওয়াই হয় না।
রফিকুর রশীদ। জন্ম ১৯৫৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, মেহেরপুর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৮৩ সালে সিলেটের এক চা-বাগানে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। মন টেকে না সেখানে। যােগ দেন কলেজ। শিক্ষকতায়। দীর্ঘ ৩৩ বছর শিক্ষকতা শেষে মেহেরপুরের গাংনী কলেজ থেকে তিনি সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেন। নিভৃতে কাব্যচর্চা দিয়ে শুরু হলেও সত্তর দশকের শেষভাগে পত্র-পত্রিকায় গল্প লিখেই তাঁর আত্মপ্রকাশ সাহিত্যজগতে। দেশের উল্লেখযােগ্য প্রায় সব কাগজে বিরামহীন লিখে চলেছেন গল্প আর গল্প, সঙ্গে উপন্যাসও। ছােট-বড় সকলের জন্যে। নির্মোহ চরিত্র চিত্রণ এবং বর্ণনার বিশ্বস্ততাই কথাশিল্পী হিসেবে তাকে এনে দিয়েছে বিশিষ্টতা। ছােটদের জন্য লেখা গল্প এবং উপন্যাসে রফিকুর রশীদ এনেছেন বিপুল বিষয় বৈচিত্র্য। প্রিয় প্রসঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ তাে আছেই, বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও কৌতূহলে ভরা বিচিত্র বর্ণে বর্ণিল ছােটদের নিজস্ব ভুবনের আলােকিত উপস্থাপন ঘটে চলেছে তার লেখা শিশু ও কিশাের সাহিত্যে। স্বপ্নজয়ের কথাশিল্পী রফিকুর রশীদ এরই মাঝে অর্জন করেছেন এম. নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, অধ্যাপক মােহাম্মদ খালেদ শিশু সাহিত্য পুরস্কার, চন্দ্রাবতী একাডেমি শিশু ও সাহিত্য সম্মাননা, কাজী কাদের নওয়াজ জন্মশতবর্ষ সম্মাননা, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, অরণি সাহিত্য পুরস্কার, কাঙাল হরিনাথ পদক ও পুরস্কার, বগুড়া লেখকচক্র স্বীকৃতি ও সম্মাননা, সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমি সম্মাননা, সিকান্দার আবু জাফর সাহিত্য পুরস্কার, দ্বিজেন্দ্র পুরস্কার (ভরত) প্রভৃতি।